প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে একসময় তিনি ছিলেন খুব জনপ্রিয়। সেই কবি মহাদেব সাহা এখন কানাডাপ্রবাসী। তবে বিদেশ-বিভুঁই ভালো লাগে না তাঁর, দ্রুতই ফিরতে চান দেশে। ৫ আগস্ট এই কবির ৭৫তম জন্মদিন। বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টেলিফোনের মাধ্যমে নেওয়া এ সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন তাঁর কবিতাভাবনা, প্রেম ও উপলব্ধির কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
আলতাফ শাহনেওয়াজ: ১৯৪৪ সালের ৫ আগস্ট পাবনার ধানগড়া গ্রামে আপনার জন্ম। তারুণ্যে আপনারা যখন কাব্যচর্চা করছেন, এই বাংলায় তখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। কবি হিসেবে আপনার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রেক্ষাপটের কতটা অবদান রয়েছে?মহাদেব সাহা: বিস্তর অবদান রয়েছে। আমার যখন কৈশোরকাল, তখন ভাষা আন্দোলন হয়েছে। ইতিহাসের অনেক ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষার্ধ দেখেছি, দেশভাগ দেখেছি, মানুষের দেশত্যাগও দেখেছি। এসব দেখতে দেখতে আমার বড় হয়ে ওঠা।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় আমি স্কুলের নিচু শ্রেণির ছাত্র হলেও সবকিছু মনে আছে আমার। আদতে আমাদের কবিতা গড়ে উঠেছে মানুষের জাগরণ, গণ-আন্দোলন—এসবের উষ্ণ নিশ্বাসে, জীবন আর মাটির গন্ধে। এটাই আমাদের কবিতার স্বাতন্ত্র্য ও মূল শক্তি। যখন কলেজে পড়ি, ততদিনে বাঙালির নবজাগরণের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ, ১৯৬২ সালের আন্দোলন, ’৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফা ও স্বাধিকারের সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালির যে জাগরণ সূচিত হয়েছিল, আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। শুধু প্রত্যক্ষদর্শী বললে ভুল হবে, আমি এগুলোর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। কবিতায় আমি যে জীবন, সমাজ ও মানুষকে অনুভব করেছি, এগুলো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছে।
১৯৬৯ সাল। বাংলা বিভাগে পড়ার পর আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে থেকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ওই মিছিলে আমি তাঁর পাশেই ছিলাম। আমার গায়েও গুলি লাগতে পারত। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘ফিরিয়ে দাও রাজবংশ’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলাম স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে। তো, এত কথা বলার অর্থ হলো, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছে আমাদের কবিতাও।
আলতাফ: আপনার অনেক কবিতায়ই দেখা যায় বিবৃতির প্রাধান্য। কোনো বিষয়কে খোলামেলাভাবে কেবল বলে যাওয়া। আছে পুনরাবৃত্তিও। মোটা দাগে এগুলো আপনার কবিতার বৈশিষ্ট্য। শুধু আপনার নয়, আপনার প্রজন্মের অনেকের কবিতায় এই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে। আপনার বা আপনাদের প্রজন্মের কবিদের এ রকম কবিতা লেখার কারণ কী?
মহাদেব: আমরা কি একই রকম বৈশিষ্ট্যে কবিতা লিখেছি? নিশ্চয়ই তা নয়। তবে এটা সত্য, যে সময়ে আমরা বেড়ে উঠেছি, পরিপুষ্ট হয়েছি—তার মধ্যে ছিল মিছিল, আন্দোলন আর অবরুদ্ধ মানুষের প্রকাশিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এ কারণে হয়তো আমাদের কবিতার মধ্যে বলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। সে হিসেবে আমাদের কবিতা নিশ্চয়ই কিছুটা বিবৃতিপ্রধান। এটা ইচ্ছাকৃত। কারণ, মানুষের সঙ্গে আমরা সরাসরি যোগাযোগ করতে চেয়েছি। জানি যে, ‘জেনুইন পোয়েট্রি কমিউনিকেটেস বিফোর ইট ইজ আন্ডার ট্রুথ’। তাই মানব-সংযোগকে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি আমরা। সম্ভবত এ কারণেই কলকাতার কবিতা থেকে আলাদা হয়েছে আমাদের কবিতা। কেবল রূপক ও চিত্রকল্পখচিত বিমূর্ত কবিতার দিকে আমরা যেতে চাইনি। তখন আমাদের কাছে কাব্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি আরাধ্য ছিল মানুষ, মানুষের মুখ। দেখো, রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’, ‘দেবতার গ্রাস’, ‘সামান্য ক্ষতি’, ‘সাজাহান’, এমনকি ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ও রোমান্টিক বিবৃতিতে ভরা। তবে আমাদের সময়ে দু-একজন অবশ্য চিত্রধর্মী কবিতার দিকে গিয়েছিল, সেসব কবিতা টেকেনি। মানুষ গ্রহণ করেনি সেগুলো।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় আমি স্কুলের নিচু শ্রেণির ছাত্র হলেও সবকিছু মনে আছে আমার। আদতে আমাদের কবিতা গড়ে উঠেছে মানুষের জাগরণ, গণ-আন্দোলন—এসবের উষ্ণ নিশ্বাসে, জীবন আর মাটির গন্ধে। এটাই আমাদের কবিতার স্বাতন্ত্র্য ও মূল শক্তি। যখন কলেজে পড়ি, ততদিনে বাঙালির নবজাগরণের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ, ১৯৬২ সালের আন্দোলন, ’৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফা ও স্বাধিকারের সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালির যে জাগরণ সূচিত হয়েছিল, আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। শুধু প্রত্যক্ষদর্শী বললে ভুল হবে, আমি এগুলোর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। কবিতায় আমি যে জীবন, সমাজ ও মানুষকে অনুভব করেছি, এগুলো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছে।
১৯৬৯ সাল। বাংলা বিভাগে পড়ার পর আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে থেকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ওই মিছিলে আমি তাঁর পাশেই ছিলাম। আমার গায়েও গুলি লাগতে পারত। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘ফিরিয়ে দাও রাজবংশ’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলাম স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে। তো, এত কথা বলার অর্থ হলো, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছে আমাদের কবিতাও।
আলতাফ: আপনার অনেক কবিতায়ই দেখা যায় বিবৃতির প্রাধান্য। কোনো বিষয়কে খোলামেলাভাবে কেবল বলে যাওয়া। আছে পুনরাবৃত্তিও। মোটা দাগে এগুলো আপনার কবিতার বৈশিষ্ট্য। শুধু আপনার নয়, আপনার প্রজন্মের অনেকের কবিতায় এই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে। আপনার বা আপনাদের প্রজন্মের কবিদের এ রকম কবিতা লেখার কারণ কী?
মহাদেব: আমরা কি একই রকম বৈশিষ্ট্যে কবিতা লিখেছি? নিশ্চয়ই তা নয়। তবে এটা সত্য, যে সময়ে আমরা বেড়ে উঠেছি, পরিপুষ্ট হয়েছি—তার মধ্যে ছিল মিছিল, আন্দোলন আর অবরুদ্ধ মানুষের প্রকাশিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এ কারণে হয়তো আমাদের কবিতার মধ্যে বলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। সে হিসেবে আমাদের কবিতা নিশ্চয়ই কিছুটা বিবৃতিপ্রধান। এটা ইচ্ছাকৃত। কারণ, মানুষের সঙ্গে আমরা সরাসরি যোগাযোগ করতে চেয়েছি। জানি যে, ‘জেনুইন পোয়েট্রি কমিউনিকেটেস বিফোর ইট ইজ আন্ডার ট্রুথ’। তাই মানব-সংযোগকে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি আমরা। সম্ভবত এ কারণেই কলকাতার কবিতা থেকে আলাদা হয়েছে আমাদের কবিতা। কেবল রূপক ও চিত্রকল্পখচিত বিমূর্ত কবিতার দিকে আমরা যেতে চাইনি। তখন আমাদের কাছে কাব্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি আরাধ্য ছিল মানুষ, মানুষের মুখ। দেখো, রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’, ‘দেবতার গ্রাস’, ‘সামান্য ক্ষতি’, ‘সাজাহান’, এমনকি ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ও রোমান্টিক বিবৃতিতে ভরা। তবে আমাদের সময়ে দু-একজন অবশ্য চিত্রধর্মী কবিতার দিকে গিয়েছিল, সেসব কবিতা টেকেনি। মানুষ গ্রহণ করেনি সেগুলো।
আলতাফ: আপনি কীভাবে নিশ্চিত যে চিত্রকল্পময় কবিতা—আপনার ভাষায় যা ‘চিত্রধর্মী’—সেগুলো টেকেনি?
মহাদেব: একদম নিশ্চিত। আমাদের কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। শত শত বই বিক্রি হয়েছে। কবিতার বই প্রথম সংস্করণে ১ হাজার ২০০ কপি ছাপা হওয়ার চল শুরু হয় আমাদের সময় থেকে। তারপর তিন-চার মাসের মধ্যে ওই বইয়ের প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়। স্বাধীনতার একদম পরপর ১৯৭২-এ বেরোনো আমার প্রথম কবিতার বই এই গৃহ এই সন্ন্যাস-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তিন মাসের মধ্যে সংস্করণ শেষ। আমি, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন কবির, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসান—সবার ভেতরে এই প্রবণতা ছিল। না, কথাটা পুরোপুরি ঠিক হলো না। আবুল হাসানের কবিতা ছিল আলাদা। নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব—কবিতায় এসব সন্ধান করেছে সে। তার কবিতা হলো আত্মমন্ময় কবিতা। আর আমরা সন্ধান করেছিলাম জীবন-মন্ময় কবিতা—জীবন ও মাতৃভূমি। দেশ, দেশের রাজনীতি—এগুলোকে তখন ঠিকঠাকমতো বুঝে উঠতে পারেনি হাসান। বোধ হয় সে কারণেই ওর কবিতায় সমাজ ও দেশকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একসঙ্গে থাকলেও কাব্যাদর্শের দিক দিয়ে সে ছিল আমাদের চেয়ে খানিকটা দূরবর্তী অবস্থানে।
আলতাফ: কিন্তু অনেকে এমন অভিযোগও করেন, কবিতায় এই অবিরল বলে যাওয়া বা বিবৃতিপ্রবণতার কারণে আপনাদের কবিতা কখনোবা তরল হয়ে গেছে।
মহাদেব: আমার তা মনে হয় না। আমার বরং মনে হয়, এতে আমাদের কবিতা সমৃদ্ধই হয়েছে। কেননা, আবার বলছি, আমাদের কবিতা জীবনমুখী। এখানে প্রেম, কাম—এগুলোর পাশাপাশি বিশেষভাবে ছিল রাজনীতি। ফলে কবিতা হেঁটেছে জনমানুষের একই সমতলে। শামসুর রাহমান তো আমাদের এক দশক আগের কবি, তিনি দেশের প্রধান কবি হয়ে উঠলেন কেন? যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষের অবলম্বন ছিল তাঁর কবিতা—সে ‘আসাদের শার্ট’ বা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’—যে নামই বলি না কেন। বিবৃতির যে ধারা, তা শামসুর রাহমান থেকে শুরু। ওই ধারায় আমি এবং আমরাও লিখেছি, যার যার স্বতন্ত্র স্বরে। আমাদের পরেও লেখা হয়েছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহসহ আরও অনেকে লিখেছেন। সেসব কবিতা জনপ্রিয়ও হয়েছে।
আলতাফ: জনপ্রিয় ধারার কবি আপনি। তাই কি এ কথা বলতে চাচ্ছেন, পাঠকের কাছে যাওয়া, বই বিক্রি হওয়া, সাধারণ মানুষের কাছে আদৃত হওয়া—এগুলো কবিতার বড় উদ্দেশ্য?
মহাদেব: অবশ্যই। এগুলো খুবই বড়। আমাদের আগে কবিতা থেকে পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমাদের আগপর্যন্ত অনেক কবিকে নিজস্ব অর্থে বা বন্ধুবান্ধবের টাকায় বই বের করতে হয়েছে। সেদিক থেকে আমরা ছিলাম ব্যতিক্রম। প্রকাশক আগ্রহ করে আমাদের বই বের করেছেন এবং তা বিক্রিও হয়েছে। আর খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, কবিতার চরণগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরা—এসব কিছুকে তোমরা যদি মূল্য না দাও, তাতে কবিতার কিন্তু কোনো ক্ষতি হবে না। হ্যাঁ, তরুণ বয়সে বিদ্রোহ থাকে, আমরাও করেছি; তবুও বলতে চাই, জীবনমুখী বা মানুষের কাছে যাওয়া কবিতা—এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের কবিতার মূলধারা।
আলতাফ: প্রেমের কবি হিসেবে বেশ সুখ্যাতি আছে আপনার। আপনারা তো জীবন দেখে ও জীবন থেকে জীবনমুখী কবিতা লিখেছেন। আপনার প্রেমের কবিতাগুলোও কি জীবন থেকে পাওয়া?
মহাদেব: বাংলা কবিতার দিকে তাকাও, কী দেখতে পাও? প্রেম আছে বাংলা কবিতায় প্রথম থেকেই। প্রেম অনুভবের বস্তু। প্রেমের অনুভূতি ছাড়া কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না। প্রেম তো ভেতরেই থাকে, বাস্তবে এবং স্বপ্ন-কল্পনায় থাকে। প্রত্যেক কবি হয়তো এসব থেকে, বিশেষ কোনো অনুভূতি থেকেই প্রেমের কবিতা লেখেন।
আলতাফ: আপনার জীবনে প্রেম আসেনি? সেই প্রেম আপনাকে কাব্যরচনায় উদ্বুদ্ধ করেনি?
মহাদেব: হয়তো করেছে, আবার করেওনি। কল্পিত প্রেম নিয়ে হয়তো লিখেছি। নিজের জীবনের প্রেমের কথা কী আর বলব! অসংখ্য নারীর ভালোবাসা আমি পেয়েছি। সেই কলেজজীবন থেকে নারীদের ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এর মধ্যে আবার অন্য কিছু খুঁজবে না, আরও সরাসরি বললে দৈহিকতাকে খুঁজবে না, কারণ, কামনাতাড়িত প্রেমের কথা আমি বলছি না। আমার কাছে প্রেম ও মাতৃস্নেহের মধ্যে কোনো পার্থক্য কখনো ছিল না, এখনো নেই। প্রেম তো এক রকমভাবে মাতৃস্নেহই। একটা ঘটনা বললেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ১৯৬১ সালে আমি ঢাকা কলেজে পড়ি, উচ্চমাধ্যমিকে। থাকি হোস্টেলে। তখন হিন্দু ছাত্রদের জন্য আগামসিহ লেনে একটা ছাত্রাবাস ছিল। একে আমরা বলতাম হোস্টেল। ওই হোস্টেলে বসবাসকালে আমি একবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম—টাইফয়েড। সে সময় টাইফয়েড ছিল কঠিন অসুখ। আমাদের হোস্টেলের পাশের বাড়িতে অপূর্ব এক সুন্দরী ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। হোস্টেলের সামনের খোলা জায়গায় আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম, তিনি বারান্দায় বসে সেই খেলা দেখতেন। আমার সঙ্গে তাঁর খুব দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তবে আমাকে দেখে তিনি হাসতেন, মিষ্টি করে হাসা। বিনিময়ে আমিও হাসতাম। ভাব বিনিময় মাত্র এটুকু। আমরা তাঁকে বলতাম উষাদি। তিনি জানতেন আমি কবিতা লিখি।
তো, হোস্টেলে যখন অমি অসুস্থ হলাম, জ্বরের ঘোরে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম, তখন অন্যদের কাছ থেকে শুনে রাতের বেলা উষাদি চলে এলেন আমার রুমে। তখন আমি সংজ্ঞাহীন। সারা রাত তিনি আমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছেন। এরপর সকালবেলা চলে গেছেন। বড় ভাগ্য না থাকলে এটা হয় না! একে তুমি প্রেমও বলতে পারো, মাতৃস্নেহও বলতে পারো। কবিতা লিখে আর কী পাওয়া যায়, বলো?
তারপর উষাদির সঙ্গে আমার আর মাত্র একবারই দেখা হয়েছিল। সেটা ঘটল তখন, যখন টাইফয়েড-আক্রান্ত আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে আমার গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। উষাদি হাত নেড়ে আমাকে বিদায় দিলেন, আমিও হাত নাড়লাম। ও-ই শেষ। কিন্তু ওই প্রেম, ওই স্নেহ আজও আমার মনের ভেতর রয়ে গেছে।
আগেই বলেছি, অনেক নারীর ভালোবাসার আবেশ আমাকে স্পর্শ করেছে। তবে মজার ব্যাপার এই যে তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার দেখা হয়নি, শুধু কথা হয়েছে। প্রেমের এসব কথাবার্তা বাদ দাও। তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, প্রেমের কবিতা লিখলেও আমি কিন্তু প্রেমিক নই। আমার লেখা প্রেমের কবিতা পড়ে অনেকে আমাকে ভালোবেসেছে, কিন্তু আমি কাউকে ভালোবাসিনি। ভালোবাসা শিখিনি। চিঠি নিয়ে আমি অনেক কবিতা লিখেছি। চিঠি পেতেও আমার ভালো লাগে। তবে চমকপ্রদ তথ্য হলো আমি মা ছাড়া কাউকে তেমনভাবে চিঠি লিখিনি। প্রেমের যোগ্য মানুষ আমি নই, তাই বোধ হয় এ জীবনে অফুরন্ত প্রেম পেয়েছি।
আলতাফ: ‘কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়’ আপনার লেখা ‘মানুষের বুকে এত দীর্ঘশ্বাস’ নামে কবিতার একটি পঙ্ক্তি। এই পঙ্ক্তির মতো আপনার কবিতার অনেক কবিতার পঙ্ক্তিতেই আছে দীর্ঘশ্বাস, আছে দুঃখ, বিষণ্নতা, বিষাদ। আপনার কবিতায় এত বিষাদ কেন?
মহাদেব: বিরহকেও আমি প্রেম মনে করি, বিষাদকে আনন্দ মনে করি। বিষাদের মধ্যেই আছে আনন্দ। কেবল কি আমার কবিতাতেই বিষাদ আছে? রবীন্দ্রনাথের কবিতার পাতায় পাতায় ভরা রয়েছে দুঃখ। গীতবিতান-এর প্রতিটি পাতা তো দুঃখ আর অশ্রুতে ভেজা। ‘আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দৌজ দ্যাট টেল অব স্যাডেস্ট’—শেলির উক্তি। তাই বলতে পারি, বিষাদই প্রথম কবিতা। আদি কবি বাল্মীকির প্রথম যে শ্লোক-উচ্চারণ: ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠা তমগম শাশ্বতী সমা’—এর মধ্যে কী আছে? বিষাদ।
আলতাফ: বাংলাদেশের আবাস গুটিয়ে স্ত্রীসহ কানাডায় ছেলের কাছে চলে গেলেন। কেন? এর নেপথ্যে কি কোনো অভিমান আছে?
মহাদেব: না, কারও প্রতি কোনো অভিমান নেই। দেশ ছেড়ে কানাডাতে গিয়েছি বাধ্য হয়ে। দেশে আমার কোনো জীবিকা ছিল না। উপরন্তু আমার ও নীলার (মহাদেব সাহার স্ত্রী) চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের জন্য প্রতি মাসেই বিপুল টাকা ব্যয় হচ্ছিল। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ছেলে তীর্থর কাছে কানাডায়, কানাডার এই শীতলতম অঞ্চল ক্যালগেরিতে চলে এলাম। এখন ফোনে আর কী বলব! নিজের কথা বলতে একদমই ভালো লাগে না। কবিতা লিখে আমি মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত করতে পারিনি। আমার সংগৃহীত বইপত্র সব দিয়ে এসেছি বাংলা একাডেমিকে। যে সময় আমার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়ার কথা, পুরস্কার-সম্মাননায় প্রীত হওয়ার কথা, সে সময় আমি মাঠ ছেড়ে দিয়েছি, রেসে নেই। আমার সম্বল শুধু কিছু কবিতা, গান আর বাংলা বর্ণমালা। এসব নিয়েই সুখে-দুঃখে থাকতে চাই আমি। জন্মভূমি ছেড়ে কারও কি ভালো লাগে? আমারও লাগে না। কিন্তু কী করব! এখন ভাবছি, ঢাকায় একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করতে পারলেই দেশে ফিরব।
আলতাফ: আসছে ৫ আগস্ট আপনার ৭৫তম জন্মদিন। দীর্ঘ জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন, অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ও ঢের। এত দিন পেরিয়ে এসে আপনার উপলব্ধি কী?
মহাদেব: কবিতাও চির-অমর কিছু নয়। পোয়েট্রি ইজ আ পানিশমেন্ট। আমি মনে করি, কবিতা লেখা এক রকম শাস্তি।পৃথিবীর সব বড় কবি—কিটস, বায়রন, র্যাঁবো, বোদলেয়ার, ডিলান টমাস, মায়াকোভস্কি, মাইকেল বা রবীন্দ্রনাথ—তাঁদের দিকে তাকাও, দেখবে সবাই একই শাস্তি ভোগ করেছেন। শেষ জীবনে ছেলেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।’ আদতে আমার তেমন কিছু বলার নেই। আমার উপলব্ধি জানতে চাও? কবিতা হলো প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ। প্রকৃতির প্রতিশোধ ভয়ংকর। কবিতা হলো প্রাঞ্জল মিথ্যা। এই মনোরম মিথ্যা বলতে বলতে আমি এখন ক্লান্ত।
No comments:
Post a Comment