Showing posts with label জীবনানন্দ দাশ. Show all posts
Showing posts with label জীবনানন্দ দাশ. Show all posts

Tuesday, May 12, 2020

বনলতা সেন - জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
 
---বনলতা সেন

আট বছর আগে একদিন - জীবনানন্দ দাশ

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাদ
মরিবার হল তার সাধ।
বধু শুয়ে ছিল পাশে-শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল জোছনায় তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয় নি ঘুম বহুকাল- লাশকাটা ঘরে মুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার
কোনোদিন জাগিবে না আর।
‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিত্বব্ধতা এসে।
তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহিন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোতে ভালোবাসে।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছে ইহাদের মন:
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘর শিহরণ
মরণেরাসথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
একা গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাতে তার হয় নাকো দেখা
এই জেনে।
অশ্বত্থের শাখা
করে নি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করে নি কি মাখামাখি?
বলে নি কি: বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইদুর এবার!
জানায় নি পেচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
জীবনের এই স্বাদ- সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের-
তোমার অসহ্য বোধ হল;
মর্গে কি ওমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প;-কোনো
নারীর প্রণয়ের ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিতা জীবনের সাধ
কোথাও রাখে নি কোনো খাদ,
সময়ের উদবর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু-আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।
জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, র্কীতি নয়, সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে:
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে
চোখ পালটায় কয়: বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু একটা ইদুর এবার–
হে প্রগাঢ় পিতামহী , আজও চমৎকার?
আমিও তোকার মতো বুড়ো হব–বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব
কালীদহে বেনো জলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

---মহাপৃথিবী

ধান কাটা হয়ে গেছে - জীবনানন্দ দাশ


ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়।

ওইখানে একজন শুয়ে আছে — দিনরাত দেখা হত কত কত দিন
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।
 
---বনলতা সেন