সকাল থেকেই পায়চারি করছেন তিনি। এক মুহূর্তের জন্যেও থামেন নি। এই দিনটা আসলেই অস্থির হয়ে যান কেমন যেন। মতি মিয়া পাশে বসে আছে লুঙ্গি কাছা দিয়ে, তার চোখ চেয়ারের পাশে রাখা ধোঁয়া ওঠা কফির দিকে। ডাহুক পাখির সালুন দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার পর এরকম ধোঁয়া ওঠা এক মগ কফি খেতে পারলে সেই রকম স্বাদ পাওয়া যেত বলে তার ধারণা। হুমায়ূন আহমেদ আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর চেয়ারে এসে বসলেন। কফির মগ তুলে ঠোঁটে ছোঁয়াতে গিয়েও আর ছোঁয়ালেন না। মতির কফির দিকে নিবদ্ধ থাকা চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন-
– মতি বলো তো এই দিনটিতে আমি এতো অস্থির থাকি কেন?
– জানিনা তো স্যার। ৩ বছর ধইরাই দেখতাসি এই দিনটা আসলে আপনে কেমন যেন অস্থির হইয়া যান। কফিটা ঠান্ডা হইয়া যাইতেসে স্যার।
– কারণ আছে মতি। কারণ আছে। আজকের দিনেই আমি পৃথিবী ছাড়া হয়েছিলাম। চান্নি পসর রাতের অপেক্ষায় রত আমি, জোছনাহীন এক রাতে বিদায় নিয়েছিলাম। প্রতি বছর এই দিনটা ঘুরে আসলে আমি আমার প্রিয়জনদের সাত আকাশ নিচে কাঁদতে দেখি। প্রতিজনের কান্নার দমকে আমি অস্থির হয়ে যাই। ইচ্ছে হয় ওদের গিয়ে বলি- তোমরা কেঁদো না, আমি ভালো আছি, এখন তোমরা ভালো থাকো।
– স্যার আপনেরে সবাই ভালবাসে দেইখাই কান্দে। আমার জন্য জানেন কেউ কান্দে না। স্যার কফিটা ঠান্ডা হইয়া গেলে খাইলে সোয়াদ পাইবেন না কিন্তু।
– আমি তো চাই না কেউ কাঁদুক। আমাকে যদি মনে রাখতে হয় তাহলে তাদের হাসির মাঝে রাখুক। আমার লেখা পড়ে, আমার বানানো সিনেমা-নাটক দেখে ওরা যে আনন্দ পেয়েছে সে আনন্দ নিয়ে হাসুক। আমার কাছের মানুষেরা যারা আমাকে কাছে পেয়েছে তারা আমাকে নিয়ে ঘেরা সুখস্মৃতি স্মরণ করে হাসুক।
– এইটা একটা হক কথা কইছেন স্যার। মর্জিনারে এখনো যখন হাসতে শুনি মনডা খুশি হইয়া যাই। মাইয়া মাইনষের হাসি আর গরম গরম কফি বাইরে গরল ভিতরে মিষ্টি। স্যার কফিটা কিন্তু…
– আরে রাখো তোমার কফি। আমি এখনো বুঝে পেলাম না যে আমার এতো এতো সৃষ্টি, হিমু-মিসির আলি সাহেব, এমনকি শুভ্রকে না দিয়ে আমাকে কেন তোমার সঙ্গ দেয়া হল। আমি তোমার চরিত্র লিখতাম যেমন বিরক্তি নিয়ে এখন তোমার সাথে কথাও বলি সেই একই বিরক্তি নিয়ে।
– স্যার গোসসা কইরেন না। গোসসা কইরা কি লাভ। কফির মগটা দেন গরম কইরা আনি, ঠান্ডা হইয়া গেসে মনে হয়।
– থাক গরমই আছে। আমি খাবো না। তুমিই খাও।
– জানিনা তো স্যার। ৩ বছর ধইরাই দেখতাসি এই দিনটা আসলে আপনে কেমন যেন অস্থির হইয়া যান। কফিটা ঠান্ডা হইয়া যাইতেসে স্যার।
– কারণ আছে মতি। কারণ আছে। আজকের দিনেই আমি পৃথিবী ছাড়া হয়েছিলাম। চান্নি পসর রাতের অপেক্ষায় রত আমি, জোছনাহীন এক রাতে বিদায় নিয়েছিলাম। প্রতি বছর এই দিনটা ঘুরে আসলে আমি আমার প্রিয়জনদের সাত আকাশ নিচে কাঁদতে দেখি। প্রতিজনের কান্নার দমকে আমি অস্থির হয়ে যাই। ইচ্ছে হয় ওদের গিয়ে বলি- তোমরা কেঁদো না, আমি ভালো আছি, এখন তোমরা ভালো থাকো।
– স্যার আপনেরে সবাই ভালবাসে দেইখাই কান্দে। আমার জন্য জানেন কেউ কান্দে না। স্যার কফিটা ঠান্ডা হইয়া গেলে খাইলে সোয়াদ পাইবেন না কিন্তু।
– আমি তো চাই না কেউ কাঁদুক। আমাকে যদি মনে রাখতে হয় তাহলে তাদের হাসির মাঝে রাখুক। আমার লেখা পড়ে, আমার বানানো সিনেমা-নাটক দেখে ওরা যে আনন্দ পেয়েছে সে আনন্দ নিয়ে হাসুক। আমার কাছের মানুষেরা যারা আমাকে কাছে পেয়েছে তারা আমাকে নিয়ে ঘেরা সুখস্মৃতি স্মরণ করে হাসুক।
– এইটা একটা হক কথা কইছেন স্যার। মর্জিনারে এখনো যখন হাসতে শুনি মনডা খুশি হইয়া যাই। মাইয়া মাইনষের হাসি আর গরম গরম কফি বাইরে গরল ভিতরে মিষ্টি। স্যার কফিটা কিন্তু…
– আরে রাখো তোমার কফি। আমি এখনো বুঝে পেলাম না যে আমার এতো এতো সৃষ্টি, হিমু-মিসির আলি সাহেব, এমনকি শুভ্রকে না দিয়ে আমাকে কেন তোমার সঙ্গ দেয়া হল। আমি তোমার চরিত্র লিখতাম যেমন বিরক্তি নিয়ে এখন তোমার সাথে কথাও বলি সেই একই বিরক্তি নিয়ে।
– স্যার গোসসা কইরেন না। গোসসা কইরা কি লাভ। কফির মগটা দেন গরম কইরা আনি, ঠান্ডা হইয়া গেসে মনে হয়।
– থাক গরমই আছে। আমি খাবো না। তুমিই খাও।
হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিচে তাকিয়ে দেখলেন বিশাল এক চাঁদ উঠেছে আকাশে। চান্নি পসর রাত। হাই পাওয়ারের চশমাটা মুছে চোখে দিয়ে দেখলেন নিনিত খিলখিল করে হাসছে ভাইয়ের কোন এক কথায়। একটা নীল শাড়ি পরা মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে হলুদ পাঞ্জাবি পরা কারও অপেক্ষায় কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটি নীল পাঞ্জাবি পরে আসায় কপট রাগ দেখিয়ে সেও হাসতে লাগলো। আরও দেখলেন চশমা হারিয়ে ফেলা এক ছেলেকে হাত না ধরে রাস্তায় দিক নির্দেশনা দিয়ে হাটাচ্ছে এক রাগী তরুণী। ছেলেটা সব আবছা আবছা দেখায় মেয়েটি হাসি চেপে রাগী রাগী গলায় বলছে- জানি তো, সব হাত ধরার ধান্ধা। চশমা হারাবা কেন! এখন নিজে নিজে পথ চলো। হুমায়ূন আহমেদ বুকভরা ভালোলাগা নিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলেন আর সামনে তাকিয়ে দেখলেন মতি মিয়া হাসি হাসি মুখে সুরুৎ সুরুৎ করে কফি খাচ্ছে।