Showing posts with label রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর. Show all posts
Showing posts with label রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর. Show all posts

Thursday, May 14, 2020

হে ভুবন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


 হে ভুবন
              আমি যতক্ষণ
          তোমারে না বেসেছিনু ভালো
              ততক্ষণ তব আলো
         খুঁজে খুঁজে পায় নাই তার সব ধন।
                ততক্ষণ
               নিখিল গগন
হাতে নিয়ে দীপ তার শূন্যে শূন্যে ছিল পথ চেয়ে।
 
              মোর প্রেম এল গান গেয়ে;
                     কী যে হল কানাকানি
দিল সে তোমার গলে আপন গলার মালাখানি।
                     মুগ্ধচক্ষে হেসে
                     তোমারে সে
গোপনে দিয়েছে কিছু যা তোমার গোপন হৃদয়ে
তারার মালার মাঝে চিরদিন রবে গাঁথা হয়ে।
 
 
  সুরুল, ২৮ পৌষ, ১৩২১  

যে-কথা বলিতে চাই - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যে-কথা বলিতে চাই,
         বলা হয় নাই,
             সে কেবল এই--
চিরদিবসের বিশ্ব আঁখি সম্মুখেই
             দেখিনু সহস্রবার
             দুয়ারে আমার।
     অপরিচিতের এই চির পরিচয়
এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়
     সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী
          আমি নাহি জানি।
 
শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;
     নদীর এপারে ঢালু তটে
          চাষি করিতেছে চাষ;
     উড়ে চলিয়াছে হাঁস
ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে।
          চলে কি না চলে
        ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত
          আধো-জাগা নয়নের মতো।
          পথখানি বাঁকা
     বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা
চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,
     নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা।
 
ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,
              ওই খেয়াঘাট,
ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে
      নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে
          যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি
              কতদিন দেখিয়াছে কবি।
শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,
     এই আলো, এই হাওয়া,
এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,
     ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে
     অকস্মাৎ নদীস্রোতে
          ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,
যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস
          হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।
 
 
পদ্মা, ৮ ফাল্গুন, ১৩২২

Friday, February 7, 2020

আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে;
          পাকে পাকে ফেরে ফেরে
        আমার জীবন দিয়ে জড়ায়েছি এরে;
              প্রভাত-সন্ধ্যার
              আলো-অন্ধকার
          মোর চেতনায় গেছে ভেসে;
               অবশেষে
     এক হয়ে গেছে আজ আমার জীবন
          আর আমার ভুবন।
     ভালোবাসিয়াছি এই জগতের আলো
          জীবনেরে তাই বাসি ভালো।
 
     তবুও মরিতে হবে এও সত্য জানি।
              মোর বাণী
     একদিন এ-বাতাসে ফুটিবে না,
     মোর আঁখি এ-আলোকে লুটিবে না,
              মোর হিয়া ছুটিবে না
              অরুণের উদ্দীপ্ত আহ্বানে;
                       মোর কানে কানে
          রজনী কবে না তার রহস্যবারতা,
     শেষ করে যেতে হবে শেষ দৃষ্টি, মোর শেষ কথা।
 
              এমন একান্ত করে চাওয়া
                    এও সত্য যত
              এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া
                    সেও সেই মতো।
     এ দুয়ের মাঝে তবু কোনোখানে আছে কোনো মিল;
                            নহিলে নিখিল
                    এতবড়ো নিদারুণ প্রবঞ্চনা
     হাসিমুখে এতকাল কিছুতে বহিতে পারিত না।
                            সব তার আলো
     কীটে-কাটা পুষ্পসম এতদিনে হয়ে যেত কালো।
 
 
  সুরুল, ২৯ পৌষ, ১৩২১-প্রাতঃকাল

Wednesday, January 22, 2020

পরিচয়

একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে
 বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে,
 তোমরা শুধায়েছিলে মোরে ডাকি
 'পরিচয় কোনো আছে নাকি,
 যাবে কোনখানে'?
 আমি শুধু বলেছি,'কে জানে'!

 নদীতে লাগিল দোলা,বাধঁনে পড়িল টান-
 একা,বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান।
 সেই গান শুনি
 কুসুমিত তরুতলে তরুণ-তরুণী
 তুলিল অশোক-
 মোর হাতে দিয়া কহিল,'এ আমাদেরই লোক'।
 আর কিছু নয়।
 সে মোর প্রথম পরিচয়।

 তার পরে জোয়ারের বেলা
 সাঙ্গ হল, সাঙ্গ হল জোয়ারের খেলা;
 কোকিলের ক্লান্ত গানে
 বিস্মৃত দিনের কথা অকস্মাৎ যেন মনে আনে;
 কনক চাপার দল পড়ে ঝুরে,
 ভেসে যায় দূরে,
 ফাল্গুণের উৎসবরাতির
 নিমন্ত্রণলিখনপাঁতির
 ছিন্ন অংশ তারা
 অর্থহারা।।

 ভাঁটার গভীর টানে
 তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে।
 নূতন কালের নবযাত্রী ছেলেমেয়ে
 শুধাইছে দূর হতে চেয়ে,
 'সন্ধ্যার তারার দিকে
 বহিয়া চলেছে তরণী কে?'
 সেতারেতে বাঁধিলাম তার,
 গাহিলাম আরবার,
 'মোর নাম এই'বলে খ্যাত হোক,
 আমি তোমাদেরই লোক,
 আর কিছু নয়-
 এই হোক শেষ পরিচয়।

কবি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাঁশি



 কিনু গোয়ালার গলি।
 দোতলা বাড়ির
 লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
 পথের ধারেই।
 লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
 মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ।
 মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
 সিদ্ধিদাতা গণেশের
 দরজার 'পরে আঁটা।
 আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব
 এক ভাড়াতেই,
 সেটা টিকটিকি।
 তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
 নেই তার অন্নের অভাব॥


 বেতন পঁচিশ টাকা,
 সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
 খেতে পাই দত্তদের বাড়ির ছেলেকে পড়িয়ে।
 শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
 সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি,
 আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
 এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
 বাঁশির আওয়াজ,
 যাত্রীর ব্যস্ততা,
 কুলির-হাঁকাহাঁকি।
 সাড়ে-দশ বেজে যায়,
 তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার॥

 ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম---
 তাঁর দেওরের মেয়ে,
 অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
 লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল---
 সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
 মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
 আমি তথৈবচ।

 ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া---
 পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥

 বর্ষা ঘনঘোর।
 ট্রামের খরচা বাড়ে,
 মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
 গলিটার কোণে কোণে
 জমে ওঠে, পচে ওঠে
 আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
 মাছের কান্‌কা,
 মরা বেড়ালের ছানা
 ছাইপাঁশ আরো কত কী যে।
 ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
 মাইনের মতো,
 বহু ছিদ্র তার।
 আপিসের সাজ
 গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
 সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
 বাদলের কালো ছায়া
 স্যাঁত্‍‌সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
 কলে পড়া জন্তুর মতন
 মূর্ছায় অসাড়!
 দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা
 জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।

 গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু---
 যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,
 বড়ো বড়ো চোখ,
 শৌখিন মেজাজ।
 কর্নেট বাজানো তার শখ।
 মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
 এ গলির বীভত্‍‌স বাতাসে---
 কখনো গভীর রাতে,
 ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে,
 কখনো বৈকালে
 ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়।
 হঠাৎ সন্ধ্যায়
 সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
 সমস্ত আকাশে বেজে ওঠে
 অনাদি কালের বিরহবেদনা।
 তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
 এ গলিটা ঘোর মিছে
 দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো।
 হঠাৎ খবর পাই মনে,
 আকবর বাদশার সঙ্গে
 হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।

 বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
 ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
 এক বৈকুণ্ঠের দিকে

 এ গান যেখানে সত্য
 অনন্ত গোধুলিলগ্নে
 সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী,
 তীরে তমালের ঘন ছায়া;
 আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার
 পরনে ঢাকাই শাড়ি,
 কপালে সিঁদুর॥

কবি -  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Wednesday, December 25, 2019

আমার মনের জানলাটি আজ হঠাৎ গেল খুলে

আমার মনের জানলাটি আজ হঠাৎ গেল খুলে
          তোমার মনের দিকে।
সকালবেলার আলোয় আমি সকল কর্ম ভুলে
          রইনু অনিমিখে।
 
          দেখতে পেলেম তুমি মোরে
          সদাই ডাক যে-নাম ধ'রে
     সে-নামটি এই চৈত্রমাসের পাতায় পাতায় ফুলে
              আপনি দিলে লিখে।
     সকালবেলার আলোতে তাই সকল কর্ম ভুলে
               রইনু অনিমিখে।
 
     আমার সুরের পর্দাটি আজ হঠাৎ গেল উড়ে
              তোমার গানের পানে।
     সকালবেলার আলো দেখি তোমার সুরে সুরে
              ভরা আমার গানে।
              মনে হল আমারি প্রাণ
          তোমার বিশ্বে তুলেছে তান,
     আপন গানের সুরগুলি সেই তোমার চরণমূলে
              নেব আমি শিখে।
     সকালবেলার আলোতে তাই সকল কর্ম ভুলে
              রইনু অনিমিখে।
 
 কবি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  সুরুল, ২১ চৈত্র, ১৩২১

যে-কথা বলিতে চাই

যে-কথা বলিতে চাই,
         বলা হয় নাই,
             সে কেবল এই--
চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই
             দেখিনু সহস্রবার
             দুয়ারে আমার।
     অপরিচিতের এই চির পরিচয়
এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়
     সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী
          আমি নাহি জানি।
 
শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;
     নদীর এপারে ঢালু তটে
          চাষি করিতেছে চাষ;
     উড়ে চলিয়াছে হাঁস
ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে।
          চলে কি না চলে
        ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত
          আধো-জাগা নয়নের মতো।
          পথখানি বাঁকা
     বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা
চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,
     নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা।
 
ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,
              ওই খেয়াঘাট,
ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে
      নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে
          যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি
              কতদিন দেখিয়াছে কবি।
শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,
     এই আলো, এই হাওয়া,
এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,
     ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে
     অকস্মাৎ নদীস্রোতে
          ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,
যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস
          হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।
 
 কবি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পদ্মা, ৮ ফাল্গুন, ১৩২২

তোমারে কি বারবার করেছিনু অপমান

তোমারে কি বারবার করেছিনু অপমান।
          এসেছিলে গেয়ে গান
              ভোরবেলা;
    ঘুম ভাঙাইলে ব'লে মেরেছিনু ঢেলা
              বাতায়ন হতে,
    পরক্ষণে কোথা তুমি লুকাইলে জনতার স্রোতে।
              ক্ষুধিত দরিদ্রসম
          মধ্যাহ্নে, এসেছে দ্বারে মম।
          ভেবেছিনু, এ কী দায়,
কাজের ব্যাঘাত এ-যে।' দূর হতে করেছি বিদায়।
 
     সন্ধ্যাবেলা এসেছিলে যেন মৃত্যুদূত
          জ্বালায়ে মশাল-আলো, অস্পষ্ট অদ্ভুত
              দুঃস্বপ্নের মতো।
     দস্যু ব'লে শত্রু ব'লে ঘরে দ্বার যত
          দিনু রোধ করি।
     গেলে চলি, অন্ধকার উঠিল শিহরি।
এরি লাগি এসেছিলে, হে বন্ধু অজানা--
          তোমারে করিব মানা,
    তোমারে ফিরায়ে দিব, তোমারে মারিব,
       তোমা-কাছে যত ধার সকলি ধারিব,
              না করিয়া শোধ
              দুয়ার করিব রোধ।
 
              তার পরে অর্ধরাতে
          দীপ-নেবা অন্ধকারে বসিয়া ধুলাতে
              মনে হবে আমি বড়ো একা
          যাহারে ফিরায়ে দিনু বিনা তারি দেখা।
              এ দীর্ঘ জীবন ধরি
          বহুমানে যাহাদের নিয়েছিনু বরি
              একাগ্র উৎসুক,
          আঁধারে মিলায়ে যাবে তাহাদের মুখ।
              যে আসিল ছিনু অন্যমনে,
          যাহারে দেখি নি চেয়ে নয়নের কোণে,
              যারে নাহি চিনি,
          যার ভাষা বুঝিতে পারি নি,
অর্ধরাতে দেখা দিবে বারেবারে তারি মুখ নিদ্রাহীন চোখে
          রজনীগন্ধার গন্ধে তারার আলোকে।
     বারেবারে ফিরে-যাওয়া অন্ধকারে বাজিবে হৃদয়ে
          বারেবারে-ফিরে-আসা হয়ে।
 
কবি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 শিলাইদা, ৮ ফাল্গুন, ১৩২২

ভাবনা নিয়ে মরিস কেন খেপে


ভাবনা নিয়ে মরিস কেন খেপে।
          দুঃখ-সুখের লীলা
     ভাবিস এ কি রইবে বক্ষে চেপে
          জগদ্দলন-শিলা।
     চলেছিস রে চলাচলের পথে
     কোন্‌ সারথির উধাও মনোরথে?
     নিমেষতরে যুগে যুগান্তরে
          দিবে না রাশ-ঢিলা।
 
     শিশু হয়ে এলি মায়ের কোলে,
          সেদিন গেল ভেসে।
     যৌবনেরি বিষম দোলার দোলে
          কাটল কেঁদে হেসে।
     রাত্রে যখন হচ্ছিল দীপ জ্বালা
     কোথায় ছিল আজকে দিনের পালা।
     আবার কবে কী সুর বাঁধা হবে
          আজকে পালার শেষে।
 
     চলতে যাদের হবে চিরকালই
          নাইকো তাদের ভার।
     কোথা তাদের রইবে থলি-থালি,
          কোথা বা সংসার।
     দেহযাত্রা মেঘের খেয়া বাওয়া,
     মন তাহাদের ঘূর্ণা-পাকের হাওয়া;
     বেঁকে বেঁকে আকার এঁকে এঁকে
          চলছে নিরাকার।
 
     ওরে পথিক, ধর্‌-না চলার গান,
          বাজা রে একতারা।
     এই খুশিতেই মেতে উঠুক প্রাণ--
          নাইকো কূল-কিনারা।
     পায়ে পায়ে পথের ধারে ধারে
     কান্না-হাসির ফুল ফুটিয়ে যা রে,
     প্রাণ-বসন্তে তুই-যে দখিন হাওয়া
          গৃহ-বাঁধন-হারা!
 
     এই জনমের এই রূপের এই খেলা
          এবার করি শেষ;
     সন্ধ্যা হল, ফুরিয়ে এল বেলা,
          বদল করি বেশ।
     যাবার কালে মুখ ফিরিয়ে পিছু
     কান্না আমার ছড়িয়ে যাব কিছু,
     সামনে সে-ও প্রেমের কাঁদন ভরা
          চির-নিরুদ্দেশ।
 
     বঁধুর চিঠি মধুর হয়ে আছে
          সেই অজানার দেশে।
     প্রাণের ঢেউ সে এমনি করেই নাচে
          এমনি ভালোবেসে।
     সেখানেতে আবার সে কোন্‌ দূরে
     আলোর বাঁশি বাজবে গো এই সুরে
     কোন্‌ মুখেতে সেই অচেনা ফুল
          ফুটবে আবার হেসে।
 
     এইখানে এক শিশির-ভরা প্রাতে
          মেলেছিলেম প্রাণ।
     এইখানে এক বীণা নিয়ে হাতে
          সেধেছিলেম তান।
     এতকালের সে মোর বীণাখানি
     এইখানেতেই ফেলে যাব জানি,
     কিন্তু ওরে হিয়ার মধ্যে ভরি
          নেব যে তার গান।
 
     সে-গান আমি শোনাব যার কাছে
          নূতন আলোর তীরে,
     চিরদিন সে সাথে সাথে আছে
          আমার ভুবন ঘিরে।
     শরতে সে শিউলি-বনের তলে
     ফুলের গন্ধে ঘোমটা টেনে চলে,
     ফাল্গুনে তার বরণমালাখানি
          পরাল মোর শিরে।
 
     পথের বাঁকে হঠাৎ দেয় সে দেখা
          শুধু নিমেষতরে।
     সন্ধ্যা-আলোয় রয় সে বসে একা
          উদাস প্রান্তরে।
     এমনি করেই তার সে আসা-যাওয়া,
     এমনি করেই বেদন-ভরা হাওয়া
     হৃদয়-বনে বইয়ে সে যায় চলে
          মর্মরে মর্মরে।
 
     জোয়ার-ভাঁটার নিত্য চলাচলে
          তার এই আনাগোনা।
     আধেক হাসি আধেক চোখের জলে
          মোদের চেনাশোনা।
     তারে নিয়ে হল না ঘর বাঁধা,
     পথে পথেই নিত্য তারে সাধা
     এমনি করেই আসা-যাওয়ার ডোরে
          প্রেমেরি জাল-বোনা।
 
কবি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
 
শান্তিনিকেতন, ২৯ ফাল্গুন, ১৩২২
 

#বলাকা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বলাকা কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছিলেন উইলিয়াম পিয়রসনকে। ১৯১৫-১৬ সালে কবির কাব্যগ্রন্থ নামক কাব্যসংকলনেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ।

এই কাব্যগ্রন্থে দেখা যায় পূর্ববর্তী গীতাঞ্জলি-পর্বের ঈশ্বরানুভূতি ও অতীন্দ্রিয় চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে কবি একটি স্বতন্ত্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন। "যৌবনের জয়গান, চলমান বিশ্বের অনিঃশেষ যাত্রা, ভাষার বর্ণাঢ্য উজ্জ্বলতা ও ছন্দের অপ্রতিহত প্রবাহ বলাকার বৈশিষ্ট্য।"

এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হল "সবুজের অভিযান", "শঙ্খ", "ছবি", "শা-জাহান", "বলাকা" ইত্যাদি।
 

যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে।
     তুই যে পারিস কাঁটাগাছের উচ্চ ডালের 'পরে
                    পুচ্ছ নাচাতে।
     তুই পথহীন সাগরপারের পান্থ,
     তোর ডানা যে অশান্ত অক্লান্ত,
          অজানা তোর বাসার সন্ধানে রে
              অবাধ যে তোর ধাওয়া;
          ঝড়ের থেকে বজ্রকে নেয় কেড়ে
              তোর যে দাবিদাওয়া।
 
যৌবন রে, তুই কি কাঙাল, আয়ুর ভিখারী।
     মরণ-বনের অন্ধকারে গহন কাঁটাপথে
                    তুই যে শিকারি।
     মৃত্যু যে তার পাত্রে বহন করে
     অমৃতরস নিত্য তোমার তরে;
          বসে আছে মানিনী তোর প্রিয়া
              মরণ-ঘোমটা টানি।
          সেই আবরণ দেখ্‌ রে উতারিয়া
              মুগ্ধ সে মুখখানি।
 
যৌবন রে, রয়েছ কোন্‌ তানের সাধনে।
     তোমার বাণী শুষ্ক পাতায় রয় কি কভু বাঁধা
                     পুঁথির বাঁধনে।
     তোমার বাণী দখিন হাওয়ার বীণায়
     অরণ্যেরে আপনাকে তার চিনায়,
          তোমার বাণী জাগে প্রলয়মেঘে
              ঝড়ের ঝংকারে;
     ঢেউয়ের 'পরে বাজিয়ে চলে বেগে
          বিজয়-ডঙ্কা রে।
 
যৌবন রে, বন্দী কি তুই আপন গণ্ডিতে।
     বয়সের এই মায়াজালের বাঁধনখানা তোরে
          হবে খণ্ডিতে।
     খড়গসম তোমার দীপ্ত শিখা
     ছিন্ন করুক জরার কুজ্‌ঝটিকা,
     জীর্ণতারি বক্ষ দু-ফাঁক ক'রে
              অমর পুষ্প তব
     আলোকপানে লোকে লোকান্তরে
              ফুটুক নিত্য নব।
 
যৌবন রে, তুই কি হবি ধুলায় লুণ্ঠিত।
     আবর্জনার বোঝা মাথায় আপন গ্লানিভারে
                         রইবি কুণ্ঠিত?
     প্রভাত যে তার সোনার মুকুটখানি
     তোমার তরে প্রত্যুষে দেয় আনি,
          আগুন আছে ঊর্ধ্ব শিখা জ্বেলে
              তোমার সে যে কবি।
          সূর্য তোমার মুখে নয়ন মেলে
              দেখে আপন ছবি।
 
 
শান্তিনিকেতন, ৪ চৈত্র, ১৩২২
 

#বলাকা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বলাকা কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছিলেন উইলিয়াম পিয়রসনকে। ১৯১৫-১৬ সালে কবির কাব্যগ্রন্থ নামক কাব্যসংকলনেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ।

এই কাব্যগ্রন্থে দেখা যায় পূর্ববর্তী গীতাঞ্জলি-পর্বের ঈশ্বরানুভূতি ও অতীন্দ্রিয় চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে কবি একটি স্বতন্ত্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন। "যৌবনের জয়গান, চলমান বিশ্বের অনিঃশেষ যাত্রা, ভাষার বর্ণাঢ্য উজ্জ্বলতা ও ছন্দের অপ্রতিহত প্রবাহ বলাকার বৈশিষ্ট্য।"

এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হল "সবুজের অভিযান", "শঙ্খ", "ছবি", "শা-জাহান", "বলাকা" ইত্যাদি।
 

পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল; ওরে যাত্রী।
     তোমার পথের 'পরে তপ্ত রৌদ্র এনেছে আহ্বান
              রুদ্রের ভৈরব গান।
                  দূর হতে দূরে
          বাজে পথ শীর্ণ তীব্র দীর্ঘতান সুরে,
                  যেন পথহারা
              কোন্‌ বৈরাগীর একতারা।
 
              ওরে যাত্রী,
     ধূসর পথের ধুলা সেই তোর ধাত্রী;
চলার অঞ্চলে তোরে ঘূর্ণাপাকে বক্ষেতে আবরি
         ধরার বন্ধন হতে নিয়ে যাক হরি
              দিগন্তের পারে দিগন্তরে।
     ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে,
          নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক,
          নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ।
পথে পথে অপেক্ষিছে কালবৈশাখীর আশীর্বাদ,
          শ্রাবণরাত্রির বজ্রনাদ।
     পথে পথে কন্টকের অভ্যর্থনা,
     পথে পথে গুপ্তসর্প গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা।
          নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ।
 
     ক্ষতি এনে দিবে পদে অমূল্য অদৃশ্য উপহার।
          চেয়েছিলি অমৃতের অধিকার--
     সে তো নহে সুখ, ওরে, সে নহে বিশ্রাম,
          নহে শান্তি, নহে সে আরাম।
          মৃত্যু তোরে দিবে হানা,
          দ্বারে দ্বারে পাবি মানা,
     এই তোর নব বৎসরের আশীর্বাদ,
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ
          ভয় নাই, ভয় নাই, যাত্রী।
     ঘরছাড়া দিকহারা অলক্ষ্মী তোমার বরদাত্রী।
 
     পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল, ওরে যাত্রী।
              এসেছে নিষ্ঠুর,
          হোক রে দ্বারের বন্ধ দূর,
          হোক রে মদের পাত্র চুর।
     নাই বুঝি, নাই চিনি, নাই তারে জানি,
          ধরো তার পাণি;
     ধ্বনিয়া উঠুক তব হৃৎকম্পনে তার দীপ্ত বাণী।
          ওরে যাত্রী
     গেছে কেটে, যাক কেটে পুরাতন রাত্রি।
 
 
কলিকাতা, ৯ বৈশাখ, ১৩২৩
 

#বলাকা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বলাকা কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছিলেন উইলিয়াম পিয়রসনকে। ১৯১৫-১৬ সালে কবির কাব্যগ্রন্থ নামক কাব্যসংকলনেও এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ।

এই কাব্যগ্রন্থে দেখা যায় পূর্ববর্তী গীতাঞ্জলি-পর্বের ঈশ্বরানুভূতি ও অতীন্দ্রিয় চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে কবি একটি স্বতন্ত্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন। "যৌবনের জয়গান, চলমান বিশ্বের অনিঃশেষ যাত্রা, ভাষার বর্ণাঢ্য উজ্জ্বলতা ও ছন্দের অপ্রতিহত প্রবাহ বলাকার বৈশিষ্ট্য।"

এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হল "সবুজের অভিযান", "শঙ্খ", "ছবি", "শা-জাহান", "বলাকা" ইত্যাদি।