Wednesday, January 22, 2020

বাঁশি



 কিনু গোয়ালার গলি।
 দোতলা বাড়ির
 লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
 পথের ধারেই।
 লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
 মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ।
 মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
 সিদ্ধিদাতা গণেশের
 দরজার 'পরে আঁটা।
 আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব
 এক ভাড়াতেই,
 সেটা টিকটিকি।
 তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
 নেই তার অন্নের অভাব॥


 বেতন পঁচিশ টাকা,
 সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
 খেতে পাই দত্তদের বাড়ির ছেলেকে পড়িয়ে।
 শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
 সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি,
 আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
 এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
 বাঁশির আওয়াজ,
 যাত্রীর ব্যস্ততা,
 কুলির-হাঁকাহাঁকি।
 সাড়ে-দশ বেজে যায়,
 তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার॥

 ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম---
 তাঁর দেওরের মেয়ে,
 অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
 লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল---
 সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
 মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
 আমি তথৈবচ।

 ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া---
 পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥

 বর্ষা ঘনঘোর।
 ট্রামের খরচা বাড়ে,
 মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
 গলিটার কোণে কোণে
 জমে ওঠে, পচে ওঠে
 আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
 মাছের কান্‌কা,
 মরা বেড়ালের ছানা
 ছাইপাঁশ আরো কত কী যে।
 ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
 মাইনের মতো,
 বহু ছিদ্র তার।
 আপিসের সাজ
 গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
 সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
 বাদলের কালো ছায়া
 স্যাঁত্‍‌সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
 কলে পড়া জন্তুর মতন
 মূর্ছায় অসাড়!
 দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা
 জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।

 গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু---
 যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,
 বড়ো বড়ো চোখ,
 শৌখিন মেজাজ।
 কর্নেট বাজানো তার শখ।
 মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
 এ গলির বীভত্‍‌স বাতাসে---
 কখনো গভীর রাতে,
 ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে,
 কখনো বৈকালে
 ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়।
 হঠাৎ সন্ধ্যায়
 সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
 সমস্ত আকাশে বেজে ওঠে
 অনাদি কালের বিরহবেদনা।
 তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
 এ গলিটা ঘোর মিছে
 দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো।
 হঠাৎ খবর পাই মনে,
 আকবর বাদশার সঙ্গে
 হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।

 বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
 ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
 এক বৈকুণ্ঠের দিকে

 এ গান যেখানে সত্য
 অনন্ত গোধুলিলগ্নে
 সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী,
 তীরে তমালের ঘন ছায়া;
 আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার
 পরনে ঢাকাই শাড়ি,
 কপালে সিঁদুর॥

কবি -  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

No comments:

Post a Comment