Showing posts with label সাক্ষাৎকার. Show all posts
Showing posts with label সাক্ষাৎকার. Show all posts

Tuesday, January 14, 2020

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সামনে প্রতিকূলতা থাকবেই: প্রিয়াঙ্কা দুবে

প্রিয়াঙ্কা দুবে


প্রিয়াঙ্কা দুবে ভারতের একজন সাংবাদিক। ভারতে গণধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ভিত্তিক গ্রন্থ 'নো নেশন ফর উইমেন' তাকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করেছে। প্রিয়াঙ্কা দুবে প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছেন ঢাকা লিট ফেস্টে আমন্ত্রিত হয়ে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন  বিশেষ প্রতিনিধি রাশেদ মেহেদী
রাশেদ মেহেদী: প্রিয়াঙ্কা, এই প্রথম ঢাকায় এলেন?
প্রিয়াঙ্কা: জি, এটাই আমার প্রথম ঢাকা সফর। এর আগে আসার কথা ভেবেছি; কিন্তু আসা হয়নি। এ বছর ঢাকা লিট ফেস্ট থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে বেশ একটা পণ করে ফেলেছিলাম, এবার যাবই। সত্যি, ঢাকায় এসে খুব ভালো লাগছে। ঢাকার মানুষ খুব অতিথিপরায়ণ, খুব ভালো।
রাশেদ মেহেদী: তার মানে ঢাকায় এসে কোনো কিছুই অসহ্য ঠেকেনি?
প্রিয়াঙ্কা: (হেসে) না, কোনো কিছু তো অসহ্য মনে হচ্ছে না। তবে ঢাকার রাস্তায় যানজটটা বেশ প্রকট। না, এটা বলছি না যে দিলিল্গতে যানজট নেই, সেখানেও অসহ্য ট্রাফিক জ্যাম আছে। কিন্তু ঢাকায় প্রতিবার ঘর থেকে বের হওয়ার আগে নিশ্চয় তোমরা ঘড়ির কাঁটায় রাস্তার দূরত্বের সঙ্গে যানজটের সময়টা হিসাব করে বের হও! (হাসি)
রাশেদ মেহেদী: তো  প্রথম যাত্রায় ঢাকায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কোনো এজেন্ডা আছে কি?
প্রিয়াঙ্কা: না, না- এসেছিই দু'দিনের জন্য। একেবারেই দু'দিনের বেশি তিন দিন থাকার সুযোগ নেই। আর ঢাকায় তো তোমরা আছ। আমার দরকার আছে বলে মনে করি না। তবে শিল্পী-সাহিত্যিকের মতো সাংবাদিকদেরও মগজে, চিন্তায় দেশ-কালের সীমারেখাটা তুলে দিয়ে ভাবতে হয়। অতএব, ভবিষ্যতের কথাটা কিন্তু এখনই বলতে পারছি না।
রাশেদ মেহেদী: না। ঠিকই বলেছেন, সময় একটা বড় বিষয়। আপনি দীর্ঘ সময় নিয়ে অনুসন্ধান করেন, যেমন প্রায় ছয় বছরের অনুসন্ধানের ফসল 'নো নেশন ফর উইমেন'।
প্রিয়াঙ্কা: দাঁড়াও, এখানে একটু কথা আছে। দীর্ঘ সময়ের বিষয়টাতেই বলতে চাই। যতটা বুঝি, কমপ্লিট সাংবাদিকতা হচ্ছে রিপোর্টিং, রিপোর্টেজ এবং অ্যানালাইসিসের সমন্বয়। এই তিনটি সাংবাদিকতার একেকটা পার্টস। তুমি যখন দিনের ঘটনা নিয়ে রিপোর্টিং করো, সেটা টেলিফোনে কাউকে দিলেও সে লিখে নিতে পারে, এখানে তোমাকে রিপোর্টেজ নিয়ে না ভাবলেও চলে, এখানে রিপোর্টিংটাই মুখ্য। কিন্তু তুমি যখন একটা ঘটনার ওপর অনুসন্ধান করে লিখছ তখন কিন্তু রিপোর্টেজটা মুখ্য হয়ে ওঠে। আর রিপোর্টেজটা কিন্তু এক ধরনের সাহিত্য। এখানে উপস্থাপনের দক্ষতা ও মুনশিয়ানার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। তুমি কীভাবে রিপোর্টটা উপস্থাপন করবে, কীভাবে তোমার গেটকিপারকে এবং পাঠককে প্রভাবিত করতে চাও, সেটা গভীরভাবে তোমাকেই ভাবতে হয়। আর একটি রিপোর্টেজ তখনই ইফেক্টিভ হয়, যখন সেখানে তোমার অ্যানালাইসিস থাকে। আর এটাই পারফেক্ট সাংবাদিকতা। আমার কথা হচ্ছে, রিপোর্টিংটা সাংবাদিকতার মৌলিক অংশ। কিন্তু রিপোর্টটা উপস্থাপনের মুনশিয়ানা, যুক্তি দিয়ে এর যথার্থতা প্রমাণ করা এবং অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে কোন দিকে গেলে আলোর রেখাটা পাওয়া যাবে, বিশ্নেষণের মাধ্যমে সেটা সামনে নিয়ে আসাটাই হচ্ছে পরিপূর্ণ সাংবাদিকতা।
রাশেদ মেহেদী: খুব ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এবার বলুন, ভারতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কতটা তেতো আর কতটা স্বাভাবিক?
প্রিয়াঙ্কা: তেতো আর স্বাভাবিকের পার্থক্যের কথা বলেছ- মধুর বলোনি- সেটাই ভালো। তা ঢাকায় তোমার অভিজ্ঞতা কেমন? যা হোক, আমাকে আগে প্রশ্ন করেছ, আমিই আগে বলি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সব রাষ্ট্রে সব সময়ই সরকারের লোকজনের কাছে উপাদেয় নয়। বিশেষ করে ভারতে কিংবা বাংলাদেশে সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতার চিত্রগুলো একই রকম। আবার পশ্চিমা উন্নত দেশেও কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ মসৃণ নয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সামনে প্রতিকূলতা থাকবেই। তোমাকে প্রতিকূলতা জয় করতেই হবে। আইনের বাধা, প্রশাসনের বাধা কোনো না কোনোভাবে থাকবেই। এই বাধা ডিঙিয়েই তোমার অনুসন্ধানটা শেষ করতে হবে। এবার বলো, ঢাকার অভিজ্ঞতা বলো।
রাশেদ মেহেদী: আপনি তো একটা ইউনির্ভাসাল বক্তব্য দিয়েছেন। অতএব এর মধ্যে ঢাকা, দিল্লি সব আছে। এরপর আর নতুন করে যোগ করার কিছু নেই। এবার 'নো নেশন ফর উইমেন' সম্পর্কে বলুন। এর উপজীব্যটা বাংলাদেশের পাঠকের সামনে যদি তুলে ধরেন-
প্রিয়াঙ্কা: খুব সংক্ষেপে বললে দিল্লিসহ কয়েকটা রাজ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ নিয়ে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তারই রিপোর্টেজ বুক 'নো নেশন ফর উইমেন'। এখানে আমি অনুসন্ধান করে শুধু ঘটনাটা বলিনি। পাশাপাশি সমাজের ভেতরে খুবই শক্তিশালী ধর্ষণের মনস্তত্ত্বকে লালন করার বিষয়টিও তথ্য দিয়ে, বিশ্নেষণ করে তুলে ধরেছি। আমার কথা হচ্ছে সমাজের ভেতরে, আর একটু জোর দিয়ে বললে সিংহভাগ পরিবারের ভেতরেই ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব যুগ যুগ ধরে যত্ন করে পেলেপুষে রাখা হচ্ছে। এ কারণেই এ সমাজে ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না। যেমন ধরো, পরিবারের সবাই মিলে নিজেদের পছন্দের ছেলের সঙ্গে একটা মেয়েকে তার অমতে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে- এটা কিন্তু গণধর্ষণের একটা আয়োজনের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু সমাজের প্রচলিত মনস্তত্ত্ব এটাকেই লালন করছে এবং প্রশ্রয় দিচ্ছে। বরং তুমি এর বিরুদ্ধে বললে সমালোচনার মুখে পড়বে। 'নো নেশন ফর উইমেন' বইটাতে আমি অনেক আলোচিত ঘটনার আরও গভীর অনুসন্ধান করে আমাদের সমাজব্যবস্থার ভেতরে ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসাহিত করার যেসব উপাদান আছে, সেটাকেই তুলে আনার চেষ্টা করেছি।
রাশেদ মেহেদী: এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বই তো একটাই। প্রিয়াঙ্কা পেশাজীবী সাংবাদিকই থাকছেন, না ভবিষ্যতে পেশাদার লেখক হয়ে উঠবেন?
প্রিয়াঙ্কা: (হেসে) আমার প্রধান পরিচয় সাংবাদিক হিসেবেই। ভবিষ্যতে আরও নতুন অনুসন্ধান নিয়ে আরও বই লেখার ইচ্ছা আছে। আর যদি ফিকশন রাইটার হতে বলো, সেটাও সময়ই বলে দেবে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতো পেশাজীবী সাংবাদিক থেকে পেশাদার কথাসাহিত্যিক হওয়ার উদাহরণ তো চোখের সামনে আছেই।
রাশেদ মেহেদী: আরও লম্বা ইন্টারভিউ করতে পারলে ভালো লাগত; কিন্তু আপাতত তো সে উপায় নেই। অতএব, আজ এখানেই শেষ করাটা ভালো। সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রিয়াঙ্কা: ডেফিনেটলি। বাংলাদেশের সাংবাদিক সহকর্মী, লেখক, সাহিত্যিকসহ সব মানুষের জন্য আমার শুভেচ্ছা। এখন থেকে সুযোগ পেলে ঢাকায় আসব, আড্ডা দেব, সেই ইচ্ছাটা জানিয়ে যাচ্ছি। আর শেষ কথা হচ্ছে- একটার পর একটা ট্রিকি কোশ্চেন করার জন্য তোমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।

 সাক্ষাৎকারটি সমকাল থেকে নেওয়া হয়েছে...

লেখালেখির অন্তর্নিহিত প্রেরণা পাই বাংলা থেকেই: মনিকা আলী

মনিকা আলী



মনিকা আলী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক, যিনি এ মুহূর্তে ইংরেজি সাহিত্যে অন্যতম বেস্ট সেলার ঔপন্যাসিক। তিনি ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্যও মনোনয়ন পেয়েছিলেন। 'ব্রিকলেন', 'ইন দ্য কিচেন', 'দ্য আনটোল্ড স্টোরি' তিনটি উপন্যাসই বিশ্বজুড়ে বিপুল সাড়া ফেলেছে। মনিকা আলী প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছেন ঢাকা লিট ফেস্টে আমন্ত্রিত হয়ে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন  বিশেষ প্রতিনিধি রাশেদ মেহেদী

রাশেদ মেহেদী: আপনার শেকড় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এসে কেমন লাগছে?
মনিকা আলী: অভূতপূর্ব অনুভূতি। ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। সেই তিন বছর বয়সে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা-মা। এরপর আর আসা হয়নি। অনেকবার আসার পরিকল্পনা করেছি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসা হয়নি। এবার আসতে পেরেছি, জীবনে অনেক বড় কিছু পাওয়া মনে হচ্ছে। লিট ফেস্টের আয়োজকদের প্রতিও অনেক কৃতজ্ঞতা।
রাশেদ মেহেদী: বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ আপনাকে কতটা ভাবায়?
মনিকা আলী: এক কথায় বললে প্রবলভাবে ভাবায়। আসলে আমার হৃদয়ের ভাষাটা তো বাংলা। আমার ভেতরটা বাংলাদেশ। আমার ভেতরে একটা বড় কষ্টবোধ আছে বাংলায় কথা বলতে না পারার জন্য। আমার লেখালেখির যে অন্তর্নিহিত প্রেরণা, সেটা বাংলা থেকেই পাই।
রাশেদ মেহেদী: বাংলা সাহিত্য পড়েন? কীভাবে দেখেন বাংলায় সাহিত্যচর্চাকে?
মনিকা আলী: আগেই বলেছি, বাংলা আমার প্রাণ। বাংলা ভাষা, সাহিত্য সবকিছুর সঙ্গেই বিনি সুতোর টান আছে। আর এবার ঢাকায় এসে বাংলাদেশের মানুষের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ দেখে অভিভূত হয়েছি। সাহিত্যের এই উৎসবে এত মানুষ আসছে, সব বয়সের মানুষ আসছে, সাহিত্যের আলোচনা উপভোগ করছে। এটাই প্রমাণ করে, সাহিত্য-সংস্কৃতি ঘিরে বাঙালির রুচিবোধ কতটা উন্নত।
রাশেদ মেহেদী: বাংলার প্রতি টান থেকেই কি 'ব্রিকলেনে'র কেন্দ্রীয় চরিত্রে বাংলাদেশের মেয়ে নাজনীন?
মনিকা আলী: 'ব্রিকলেন' আমার প্রথম উপন্যাস। ঠিকই বলেছেন, এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ময়মনসিংহের তরুণী নাজনীন। আপনি জেনে থাকতে পারেন, আমার বাপ-দাদার বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। এ কারণেই ওই এলাকার একটা চরিত্র বেছে নেওয়া। উপন্যাসে তরুণী নারীর সঙ্গে তার দ্বিগুণ বয়সী এক ব্যক্তির বিয়ে এবং সেই সংসারের টানাপোড়েনের গল্পটা উঠে এসেছে।
রাশেদ মেহেদী: সংসারের টানাপোড়েনের গল্প 'ব্রিকলেন' থেকে 'ইন দ্য কিচেনে' এসে কি কিছুটা সরে গেছে, রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার আছে।
মনিকা আলী: আমার লেখা সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে, এজন্য ভালো লাগছে। আসলে ফিকশনে গল্পের ভেতরে থ্রিলিং বিষয়টা সব সময়ই থাকে। ব্রিকলেনেও নাজনীন-চানুর জীবনে ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতরে এক ধরনের থ্রিলিং আছে। আবার ইন দ্য কিচেনে গ্যাব্রিয়েল-লেনার সম্পর্কের জন্ম, এগিয়ে চলা, পরিণতি সবকিছুই অন্য ধরনের থ্রিল। আসলে ফিকশনে গতিময়তার অদৃশ্য শক্তিই হচ্ছে থ্রিল। আমার তৃতীয় উপন্যাস 'দ্য আনটোল্ড স্টোরি' আরও বেশি থ্রিলিং মনে হবে পাঠকের কাছে। এর কারণটা বুঝতেই পারছেন। প্রিন্সেস ডায়ানার চরিত্রকে কেন্দ্র করে গল্পটা নির্মিত হয়েছে। ডায়ানাকে ঘিরে বিশ্ববাসীর অসীম কৌতূহল রয়েছে।
রাশেদ মেহেদী: আপনি জনপ্রিয় লেখক, বেস্ট সেলার লেখক। এটাকে কীভাবে উপভোগ করেন?
মনিকা আলী: আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কারণ খুব সহজেই ব্রিকলেনের জন্য ভালো প্রকাশক পেয়েছি আমি। প্রথম বই বের করার জন্য ভালো প্রকাশক পাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে জায়গায় আমি ভাগ্যের আশীর্বাদ পেয়েছি। এরপর পাঠকের কাছে গল্পটা জনপ্রিয় হওয়ার বিষয়টিও কিছুটা ভাগ্যের। তবে লেখক কীভাবে গল্প বলছেন এবং সেটা কতটা মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছে, সেটার ওপর পাঠকপ্রিয়তা নির্ভর করে। আমার এই আত্মবিশ্বাস আছে, আমার লেখা পাঠককে স্পর্শ করতে পেরেছে।
আর আপনি যদি বেস্ট সেলারের কথা বলেন, সেটাকে অগ্রাহ্য করি না। কিন্তু আমি একজন লেখক এবং বিপুল পাঠকের পছন্দের লেখক, এটা ভাবতে নিজের ভেতরটা পুলকে ভরে যায়।
রাশেদ মেহেদী: তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে ছাপা বই কতটা আবেদন ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয়?
মনিকা আলী: তথ্যপ্রযুক্তি মানুষকে এক ধরনের উপযোগ দেয়। ছাপা বই আরেক ধরনের উপযোগ দেয়। ছাপার অক্ষরে যেটা পড়তে ভালো লাগে সেটা কম্পিউটারের পর্দায় পড়তে আপনার ভালো লাগবে না। পশ্চিমা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির, স্মার্ট ডিভাইসের এত বিস্ময়কর আধিপত্য সত্ত্বেও সেখানেও ছাপা বইয়ের বিক্রি কিন্তু কমেনি; বরং অনেক দেশে বেড়েছে। এ কারণে আমি আত্মবিশ্বাসী, ছাপা বইয়ের আবেদন কমাতে পারবে না তথ্যপ্রযুক্তি।
রাশেদ মেহেদী: যদি এমন হতো, মনিকা আলী বাংলায় একটা উপন্যাস লিখেছেন এবং সেটা ঢাকায় অমর একুশে বই মেলায় বেস্ট সেলার হয়েছে। অনুভূতিটা কেমন হতো?
মনিকা আলী: সেটা হতো আমার জীবনের অতুলনীয় অনুভূতি। বাংলাদেশে আমার শেকড়। সে স্বপ্নটা বুকের মধ্যে আছেই।
রাশেদ মেহেদী: আপনাকে ধন্যবাদ।
মনিকা আলী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকারটি সমকাল থেকে নেওয়া হয়েছে

Thursday, December 5, 2019

‘আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় আলস্য, নারীর চেয়েও প্রিয়’- হাসান হাফিজ

 ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—এই অমর পঙ্ক্তিই বিখ্যাত করেছে কবি হেলাল হাফিজকে, পাল্টে দিয়েছে তাঁর জীবনধারাও। ৭ অক্টোবর বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই কবির ৭২তম জন্মদিন। জন্মদিনের ক্ষণে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়ে প্রথমবারের মতো তিনি উন্মোচন করলেন তাঁর লেখালেখি, প্রেম, বিরহসহ জীবনের নানা অজানা অধ্যায়। 
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান হাফিজ
হাসান হাফিজ: ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নামে একটি কবিতা লিখে যৌবনেই বিখ্যাত হয়ে যান আপনি, সেই কবিতায় তখন লিখেছিলেন ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ বর্তমানে জীবনসায়াহ্নে এসে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে ওই ধরনের পঙ্ক্তি কি আর লিখতে ইচ্ছা করে? কী মনে হয় এখন এই কবিতার দিকে তাকিয়ে?
হেলাল হাফিজ: ‘এখন যৌবন যার...’, এই দ্যুতিময় পঙ্ক্তির যিনি স্রষ্টা, তিনি তো চিরনবীন। বাস্তবে তার বয়স যতই হোক না কেন। এটা ঠিক, শরীর একটা বড় ফ্যাক্টর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমাজে যত দিন অন্যায় উৎপীড়ন অনিয়ম অনাচার থাকবে, এই পঙ্ক্তিমালাকে আশ্রয় করে প্রতিবাদী কিছু মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে। রুখে দাঁড়াবে অন্যায় ও বৈষম্য। এই কবিতাপঙ্ক্তি তাদের প্রাণিত করবে। এমনটা হতেই পারে যে বেশির ভাগ মানুষ ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকতে চাইবে। কলাটা-মুলোটার জন্য। কিন্তু কিছু মানুষ তো ব্যতিক্রমী থাকবেই। তারা রুখে দাঁড়াবে। অন্যায়-অবিচারের অবসান চাইবে।
হাসান: এই কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাই।
হেলাল: কবিতাটা লেখা হয়েছিল ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। তখন জাতি ছিল স্বাধীনতা-উন্মুখ, দেশ ছিল টালমাটাল। ওই সময়ে দেশ যে কেমন অগ্নিগর্ভ ছিল, এখনকার ছেলেমেয়েরা তা চিন্তাও করতে পারবে না। আজকাল মিছিল-মিটিং হয় টাকার বিনিময়ে। সে সময়ে এ রকমটা হতো না। সবই হতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আদর্শের একটা ব্যাপার ছিল। আমি কোনো রাজনৈতিক বা ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না; না ছাত্রজীবনে, না কর্মজীবনে। কোনো মিছিলে আমি কখনো যাইনি। তবে ভেতরে-ভেতরে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বপ্ন-প্রত্যাশা, আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারটি বুকে ধারণ করতাম ঠিকই। ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—ওই কবিতাটা সময়ই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে।
হাসান: সময় তো আপনাকে দিয়ে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লিখিয়ে নিল, কিন্তু এ কবিতার কথা মানুষ জানল কীভাবে?
হেলাল: ছফা ভাই (আহমদ ছফা) ও কবি হুমায়ুন কবির সদ্য লেখা সেই কবিতাসহ আমাকে নিয়ে গেলেন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা অফিসে, স্বনামধন্য কবি আহসান হাবীবের কাছে। হাবীব ভাই তখন দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করেন। তিনি কবিতাটি পড়লেন। তারপর মিষ্টি করে একটু হাসলেন। পড়া শেষে বললেন, শোনো তোমরা, এই কবিতা ছাপা যাবে না। ছাপলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। পত্রিকা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবে একটা কথা বলি, হেলালের আর কোনো কবিতা না লিখলেও চলবে। অমরত্ব ওর করায়ত্ত হয়ে গেছে।
ওই একটা কবিতা আমার জীবনকে পাল্টে দিয়েছে। কর্মজীবনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা, মানুষজনের আদর-আপ্যায়ন যা পেয়েছি জীবনে, তার পেছনে এই কবিতার বড় অবদান রয়েছে। আমি যখন ছাত্র, তখনই আমার চাকরি হয়ে যায় দৈনিক পূর্বদেশ-এ। সেটা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী দ্বিধান্বিত ছিলেন, ছাত্রকে কেমন করে চাকরি দেবেন। তখন অবজারভার হাউসের বড় কর্তা কবি আবদুল গনি হাজারী হায়দার ভাইকে বলেন, যে ছেলে এমন কবিতা লিখতে পারে, তার ব্যাপারে অন্য কোনো কিছু বিবেচনার দরকার নেই। তুমি বাপু, এখনি নিয়োগপত্র দিয়ে দাও ওকে। ব্যস, চাকরি হয়ে গেল আমার।
হেলাল হাফিজ। ছবি: জিয়া ইসলামহেলাল হাফিজ। ছবি: জিয়া ইসলামহাসান: আপনার জীবন নিয়েও রয়েছে নানা কিংবদন্তি। আজীবন হোটেলে হোটেলে কাটালেন। প্রেসক্লাবে আড্ডা দিয়ে জীবন পার করলেন। জীবনটাকে এমনভাবে বইতে দিলেন কেন?
হেলাল: ওই যে বললাম, ওই একটি কবিতা আমার জীবনধারা পাল্টে দিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে ওই কবিতা আমাকে রীতিমতো স্টার বানিয়ে দেয়। এখন কী মনে হয় জানো, তা-ই বোধ হয় কাল হয়েছে। উত্তাল উনসত্তরের অগ্নিঝরা সময়ে ওই কবিতা লেখার পর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকল আমার জীবনে। মাত্র দুই রাতে গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান হিসেবে এই পঙ্ক্তি লেখা হলো। চিকা মারা যাকে বলে। এখনকার প্রজন্ম অবশ্য চিকা মারা কী, সেটার মর্ম বুঝতে পারবে না। গভীর রাতে, ভীতিকর পরিবেশে দেয়াললিখনরত তরুণদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কী করছ? উত্তরে ওরা বলেছিল, চিকা (ছুঁচো) মারছি। সেই থেকে দেয়াললিখনের কাজকে বলা হতো চিকা মারা।
সেই সময় এমন হতো, হল থেকে ক্লাসে যাচ্ছি, টিএসসিতে যাচ্ছি, মেয়েরা বলাবলি করত, ওই যে কবি যায়। আমার নাম বলত না, ওই কবিতার কথা বলত। স্বাধীনতার পরও চার-পাঁচ বছর আমি সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (সাবেক ইকবাল হল) ছিলাম। তখন নিয়ম ছিল, পরীক্ষা হয়ে গেলে হলের সিট ছেড়ে দিতে হতো। প্রভোস্টকে বলায় তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি থাকতে পারবে। তবে বাবা, একটু আড়ালে-আবডালে থাকবে।’ ১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্র্যাজেডির পর হল ছেড়ে দিই আমি। টিএসসিতে কখনো আমাকে নিজের পয়সায় খেতে হয়নি ওই কবিতার কারণেই।
আমি একটু দুষ্টুও ছিলাম সে সময়। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক ক্লাস ওপরে পড়তেন। তখন তাঁকে দেখলেই দুষ্টুমি করে বলতাম, ওই যে অড্রে হেপবার্ন যায়। বঙ্গবন্ধুর বুকে মাথা রেখেছে তাঁর আদুরে জ্যেষ্ঠা কন্যা—এ রকম একটা ছবি আছে। ওই ছবি দেখলে আমার এই নামকরণের সারবত্তাটা তুমি বুঝতে পারবে। শেখ হাসিনাকে যে অড্রে হেপবার্ন বলতাম, তিনি সেটা বেশ উপভোগ করতেন বলে মনে হয়। সেই সময়ে সোফিয়া লরেন, অড্রে হেপবার্ন, সুচিত্রা সেন—এঁরা ছিলেন বিখ্যাত নায়িকা।
হাসান: ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নিয়ে আর কোনো স্মরণীয় স্মৃতির কথা মনে পড়ে?
হেলাল: বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বিভাগ ছাড়িয়ে আমার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। তত দিনে আরও কয়েকটি মিষ্টি প্রেমের কবিতা লিখেছি। সেসব যে খুব শিল্পগুণসম্পন্ন, তা নয়। তখনকার সমাজ তুলনামূলকভাবে সুস্থির ছিল। কোমলতা ছিল মানুষের মনে। যেমন, এতকাল পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনে রেখেছেন। আগেই বলেছি, আমার জীবন মূলত জাতীয় প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক। শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিবছরই প্রেসক্লাবে আসেন—কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, কখনোবা বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবেও। আমি কখনোই তাঁর ধারেকাছে যাই না। ২০১৪ সালে যখন আমি তাঁর হাত থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করি, তখন ধরা পড়তেই হলো। একাডেমি মঞ্চে পুরস্কার নিচ্ছি। তাঁর নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের আগেভাগেই বলে দিয়েছেন কোনো কথাবার্তা নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রটোকল ভেঙে আমার সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বললেন। সে এক বিড়ম্বনাময় পরিস্থিতি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের টুনটুনি কেমন আছে রে, ওর কোনো খবর জানিস? দুষ্টু মেয়ে টুনটুনি স্বাধীনতা-পূর্বকালে ছাত্রলীগ করত। প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন হাসির কথা। হাসি তৎকালীন ছাত্রলীগের চার খলিফার একজন প্রয়াত আবদুল কুদ্দুস মাখনের স্ত্রী। অনির্ধারিত কথায় কথায় এইভাবে চার-পাঁচ মিনিট সময় কেটে গেল। নিরাপত্তাকর্মীরা ভীষণ উসখুস করছিলেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে পরে আবার দেখা হয় গণভবনে। আমার চোখের চিকিৎসার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ওকে অফিসে নয়, গণভবনে আসতে বলো। তাই গেলাম। প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা ছিল। মুঠোফোন, কাঁধে ঝোলা সঙ্গে নিয়েই আমি গণভবনে ঢুকেছি। অথচ এগুলো নিয়ে ঢোকা যায় না। কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে। প্রধানমন্ত্রী আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন বলে কোনো অসুবিধা হয়নি। শেখ হাসিনা আমার ঝোলা হাতড়ে দেখলেন। বললেন, কী আছে এর ভেতরে? চোখের চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি বললেন, যত যা লাগে, আমি দেব।
হাসান: সেই সময়—মানে আপনার যৌবনের কথা কি আরেকটু বিশদভাবে বলবেন?
হেলাল: বরাবরই আমি অব্যবস্থিতচিত্ত মানুষ। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া অনিশ্চিত। একধরনের বোহিমিয়ান জীবন যাপন করি। খাবারদাবারের কষ্ট অবশ্য হয়নি। অগ্রজ কবি শামসুর রাহমান ও হাসান হাফিজুর রহমানের কাছে ধরনা দিয়ে আমি আর আবুল হাসান খাবারের জন্য টাকাপয়সা নিতাম। হাসান ভাই পাঁচ টাকার বেশি দিতেন না। ইচ্ছা করেই। তিনি বলতেন, তাহলে এরা উল্টা-পাল্টা খরচ করবে। তখন পাঁচ টাকা কিন্তু অনেক। এই টাকাপয়সার ফেরে পড়ে সে সময় এক-আধটু অনৈতিক কাজও যে করিনি, তা নয়। কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র একটা প্রবন্ধ ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের কবিতায় প্রকৃতি’। বাংলা একাডেমির পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেটা একটু অদলবদল করে নতুন একটা প্রবন্ধ দাঁড় করিয়ে ফেললাম। সেটা ছাপা হলো পাকিস্তানী খবর-এ। সুশোভন আনোয়ার আলী ছাপলেন। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। তো, ওই অদলবদল মানে চুরি করে লেখা প্রবন্ধের জন্য সম্মানী কত পেলাম, জানো? ৭৫ টাকা। সে এক বিশাল অঙ্ক। যেদিন এত্তগুলো টাকা বিল পেলাম, কীভাবে তা খরচ করব, ঠিকঠাক ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না। সে সময় আমার মধ্যে যে উচ্ছৃঙ্খলতা এসেছিল, তা-ও কিন্তু কবিতার জন্যই।
হাসান: বিয়ে করলেন না কেন?
হেলাল: আমি বিয়ে করিনি, এটা ঠিক। তবে এটাও তো ঠিক হতে পারে যে কোনো মেয়েও আমাকে বিয়ে করেনি বা করতে চায়নি।
হেলাল হাফিজ। ছবি: জিয়া ইসলাম
হেলাল হাফিজ। ছবি: জিয়া ইসলামহাসান: আপনার কবিখ্যাতি যেমন প্রবল, তেমনি নারীভাগ্যও তো বেশ ভালো। এই ব্যাপারটা কি একটু খোলাসা করে বলা যাবে?
হেলাল: স্কুলজীবন থেকেই আমাকে দেখে আকৃষ্ট হতো মেয়েরা। সুশ্রী ছিলাম। খেলাধুলা প্রিয় ছিল। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও সফল ছিলাম। বাংলা ও ইংরেজি কবিতার আবৃত্তি, গল্পবলা, উপস্থিত বক্তৃতায় পুরস্কার পেতাম। ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছি প্রায়ই। সুন্দর হাতের লেখার জন্যও পুরস্কৃত হয়েছি বহুবার। আমার পুরস্কারের সব বই নেত্রকোনা পাবলিক লাইব্রেরিতে উপহার হিসেবে দিয়ে দিই। এর বিনিময়ে আমার আব্বাকে পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য পদ দেওয়া হয়েছিল।
তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর অসংখ্য বান্ধবী হলো আমার। কোনো অভাব ছিল না। আবার স্বাধীনতার পর যখন পূর্বদেশ-এর মতো কাগজের সাহিত্য সম্পাদক হলাম, সেটাও একটা বাড়তি সুযোগ তৈরি করে দিল।
হাসান: নারীদের কাছ থেকে কী ধরনের উপহার বেশি পেয়ে থাকেন আপনি?
হেলাল: সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি উপহার পেতাম চুমু, ফুল, কলম। নানান নামের সুগন্ধি, মধ্যাহ্নভোজের টাকা, শার্ট ও প্যান্টের পিস (সত্তরের দশকে, রেডিমেড প্যান্ট তেমন একটা পাওয়া যেত না)। গত পাঁচ-সাত বছরে সবচেয়ে বেশি উপহার যা পাচ্ছি, তা হলো গলার মালা। হাতের ব্রেসলেট। আমার কিছু মেয়ে ভক্ত আমাকে এগুলো পরতে বাধ্য করছে। এসব তারা জোগান দিয়েও চলেছে।
হাসান: আপনার জীবনে তো অজস্র প্রেম এসেছে। প্রেমের কথা বলুন...
হেলাল: কৈশোরে হেলেন নামের এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম হয়েছিল। আমার চেয়ে বয়সে একটু ছোট ছিল। কবিতায় তার কথা লিখেছি। ওর সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব, ভালো লাগা, পরে হলো প্রেম। সেটা ঘটেছিল নেত্রকোনায়। ওই প্রণয় পরিণতি পায়নি। ওকে খুব পছন্দ করতাম। সে-ও ভালোবাসত আমাকে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো সে।
১৯৭৩ সালে যখন আমার অনার্স পরীক্ষা সামনে, তখন বড় দুটি মর্মান্তিক ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় আমার। আমার আব্বা—যিনি আমার মা-ও ছিলেন—হঠাৎই মারা যান। এর এক-দেড় মাস পর হেলেনের সঙ্গে আকস্মিক ব্রেকআপ হয়ে গেল আমার। হেলেনের কথা সবিস্তারে এই প্রথম বলছি। তো এখন যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, সেটা আগে ছিল পাবলিক লাইব্রেরি। ওই চত্বরে বিখ্যাত ভাস্কর নভেরা আহমেদের বেশ কিছু ভাস্কর্য ছিল। একটি ভাস্কর্যের পাশে আমরা দুজন বসলাম একদিন। হেলেন আমাকে চমকে দিয়ে বলল, আমি তো অন্য একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি।
হাসান: এটা শুনে কী প্রতিক্রিয়া হলো আপনার?
হেলাল: আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বজ্রাহত। চোখে পানি এসে গেল। হায়! এত গভীর ভালোবাসার এই পরিণতি! এত বড় আঘাত! সামাল দেওয়া অত্যন্ত শক্ত কাজ। একেবারেই ভেঙে পড়লাম। অসম্ভব অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। সেই বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েকটি বছর লেগে গেল।
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—কবিতায় এটি লিখলেও নিজে কখনো মিছিলে যাননি হেলাল হাফিজ। ছবি: জিয়া ইসলাম‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—কবিতায় এটি লিখলেও নিজে কখনো মিছিলে যাননি হেলাল হাফিজ। ছবি: জিয়া ইসলামহাসান: সে সময় কি আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন?
হেলাল: হ্যাঁ। ভেবেছিলাম। একাধিকবার আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারিনি। তবে এই প্রবণতা একসময় প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিল আমাকে।

হাসান: এই যে কয়েকবার আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টার কথা বললেন, তার সবই কি নারীর কারণে?
হেলাল: তা বলতে পারো। অলমোস্ট সে কারণেই। আত্মহত্যা যে করতে পারলাম না, তার পেছনেও বড় দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, সবিতা মিসট্রেসের অবদান। তিনি বিদুষী স্কুলশিক্ষিকা, নেত্রকোনায় আমার শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার মা-ছেলের মতো সম্পর্ক ছিল প্রথমটায়, পরে সেটা বন্ধুত্বের সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়। তাঁর দীক্ষা ও রুচিতে আমার মানস গঠিত হয়েছিল। সেটা একটা শক্তি। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, কবিতার জন্য মানুষের যে ভালোবাসা-আদর আমি পেয়েছি, তার ইতিবাচক প্রভাব। এই দুই কারণ না থাকলে আমি মরেই যেতাম; অথবা অথর্ব, সাদামাটা জীবন যাপন করতাম।

হাসান: আর কোনো প্রেম? আর কোনো গোপন বেদনার কাহিনি?
হেলাল: হ্যাঁ। আরও আছে। নেত্রকোনায় আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, তখন শঙ্করী বলে অসামান্য সুন্দরী এক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল আমার। সে ছিল আমার সহপাঠী। পরস্পরকে আমাদের ভীষণ ভালো লাগত। ওর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি হতে পারতাম প্র্যাকটিক্যাল বা ব্যবহারিক ক্লাসের সময়। বায়োলজি ক্লাসের জুয়োলজি ও বোটানির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস যখন হতো, শিক্ষকেরা বিশেষ থাকতেন না। এ সময় মেলামেশার সুযোগ হতো বেশ। অসম্ভব সুন্দরী তরুণী শঙ্করীর প্রেমে হাবুডুবু খেত কলেজের অনেকেই।

সন্ধ্যায় প্রতিদিন আমরা প্রচলিত পথে না গিয়ে রেললাইন ধরে পাশাপাশি হাঁটতাম। সে এক আশ্চর্য রোমান্টিক সময় গেছে আমাদের। একদিনের কথা বলি। বোটানির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস চলছে। রক্তজবা ফুল ডিসেকশনের জন্য দেওয়া হয়েছে। জবা ফুলের দুটি কেশর থাকে। একটি পুং কেশর, অন্যটি স্ত্রী কেশর। আমার পাশের টেবিলেই ছিল শঙ্করী। আমি ওকে বললাম, শঙ্করী, পুং কেশর কোনটা, দেখিয়ে দাও তো একটু। শঙ্করী একটু মুচকি হেসে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমাকে বলল, তোমার মতো ভীরুকে পুং কেশর চিনিয়ে দিয়ে আমার কী লাভ?

সেই শঙ্করী পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়েছে। ডাক্তার হয়েছে। আমিও ডাক্তারি পড়তে চেয়েছিলাম। হয়নি। শঙ্করীকে পাওয়া হলো না আর। আমি চলে এসেছি কবিতার পথে। ওই যে হেমন্তের একটা গান আছে না, ‘আজ দুজনার দুটি পথ ও গো দুটি দিকে গেছে বেঁকে...।’
হাসান: কবিতা ও নারী—কে বেশি রহস্যময়ী?
হেলাল: দুটোই খুব রহস্যময়ী। একজনের প্রাণ আছে। কবিতা যদি শিল্পগুণসমৃদ্ধ হয়, তাহলে সেটারও প্রাণ থাকে। নারীকে আমি শুধু নারী হিসেবেই দেখতে চাই না, তাকে দেখতে চাই মানুষ হিসেবে। আবার এ কথাও তো সত্য যে নারীরও পুরুষকে দরকার। নারীরও তো আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন আছে পুরুষকে নিয়ে। তারও গভীর, তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে স্পর্শ করার, ঘ্রাণ নেওয়ার। দুই তরফেই এক রকম চাহিদা।
আমার কবিতাপুঞ্জে এত যে আকুতি, এত প্রেম তার সিংহভাগ কিন্তু বিচ্ছেদ-বিরহকেন্দ্রিক। এই বিষয়টা শুধু আমার কবিতায়ই মিলবে না, আমার যাপিত জীবনেও একই ধরনের চিত্র তুমি পাবে। তিন বছর বয়সে যখন মাকে চিরতরে হারালাম, সেটার আফটার অ্যাফেক্ট বুঝতে বুঝতে অনেকটাই সময় লেগে গেল আমার। দুঃখ-বিরহ-বিষাদ কিন্তু নিছক কান্নাকাটির বিষয় নয়, এটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করারও বিষয়। প্রকৃত শিল্পী ও কবি তিনিই, যিনি এই কষ্ট-দুঃখ-বিরহ-বিচ্ছেদকে মহৎ শিল্পে রূপান্তরিত করতে পারেন। শিল্পের জন্য বিরহ কিন্তু খুবই জরুরি।
হাসান: আপনার প্রিয় জিনিসগুলো সম্পর্কে জানতে চাই—প্রিয় পোশাক, রং, খাবার, ফুল, মাছ ইত্যাদি।
হেলাল: আমার প্রিয় পোশাক প্যান্ট-শার্ট। পাঞ্জাবি প্রায় পরিই না, মাঝেমধ্যে পরা হয়। আমি ভাটি অঞ্চলের মানুষ, নেত্রকোনায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা। প্রিয় খাদ্য হলো ভাত-মাছ, শুঁটকি। ফলের মধ্যে কলা আমার বেশ প্রিয়। প্রতিদিনই খাওয়া হয়। এই ফল সারা বছর পাওয়া যায়। আম-কাঁঠালও বেশ প্রিয় আমার।
কলা খাওয়ার একটা সুবিধা আছে। সেটা কী, জানো, হাত ময়লা হয় না। হাত ধুতেও হয় না। ফলের মৌসুমে সুহৃদ-অনুরাগীরা আমার জন্য কাঁঠাল নিয়ে আসেন। ঢাকার বাইরে থেকেও আনেন কেউ কেউ। সুহৃদ, সহকর্মী বন্ধুরা, বউমায়েরা প্রায়ই তাঁদের বাড়িতে রান্না করা আনাজ-তরকারি আমার জন্য নিয়ে আসেন। ও হো, বেগুনভর্তা আমার বড্ড পছন্দের। আর মাছের কথা বলছ? সব মাছই ভালো লাগে। মাগুর মাছের কথা বলি। বেশ প্রিয়। ইলিশও পছন্দের। দেশি কই মাছ খেতে ভালো লাগে। কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকিভর্তা পছন্দ করি ভীষণ। মাষকলাইয়ের ডালও বেশ ভালো লাগে।
আমার প্রিয় রং হলো নীল। বেদনার রং তো। জীবনের আনন্দ ও বেদনার আবেগের সবকিছুই খুঁজে পাই নীলের মধ্যে। লাল রংও ভীষণ ভালো লাগে। এটা দ্রোহের রং, বিপ্লবেরও।
প্রিয় ফুল হচ্ছে কচুরিপানার ফুল। এটা কেন প্রিয়, তারও একটা মজার ইতিহাস আছে। আগেই বলেছি, আমার প্রিয় মানুষ ছিলেন সবিতা মিস্ট্রেস। আমার মতো মাতৃহীন এক বালককে তিনি মাতৃস্নেহ দিয়েছেন। তাঁর প্রেমিক ছিলেন হক ভাই। নেত্রকোনা শহরে মগরা নদীর ওপারে থাকতেন সেই হক ভাই। গোপনে ওঁরা দেখাসাক্ষাৎ করতেন। হক ভাই তাঁর প্রেমিকার জন্য প্রতিদিন একটা করে কচুরিপানার ফুল নিয়ে আসতেন। একদিন সবিতা মিস্ট্রেস বললেন, ‘এখন থেকে দুটো করে ফুল আনবে। একটা আমার জন্য, আরেকটা হেলালের জন্য।’ হক ভাই তা-ই করতে থাকলেন। কচুরিপানার ফুলের প্রতি সেই প্রিয়তা আমার আজও রয়ে গেছে।
যৌবনে হেলাল হাফিজ, ১৯৭৩।  ছবি: শামসুল আলম আলমাজীযৌবনে হেলাল হাফিজ, ১৯৭৩। ছবি: শামসুল আলম আলমাজীহাসান: কবি হওয়ার জন্য, ভালো কবিতা লেখার জন্য কী কী গুণাবলি থাকা আবশ্যক বলে আপনি মনে করেন? একটি কবিতা কীভাবে মানুষকে নাড়া দেয়?
হেলাল: কবিতা জন্মগতভাবে পাওয়া বিশেষ একটা বিষয়। কেউ কেউ এটা নিয়েই জন্মায়। অগ্রজ বা নিকটাত্মীয় কেউ লেখক বা শিল্পী থাকলে প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে তা সহায়ক হয়। প্রতিভার পরিশীলন, লালন, বিকাশের জন্য পড়াশোনার বিকল্প নেই। কবিতা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি মাধ্যম। কোন কবিতা কাকে কখন নাড়া দেবে, সাড়াজাগানিয়া হবে, তা আঁচ করা মুশকিল। এটা খুবই ট্রিকি একটা ব্যাপার।

হাসান: প্রধানত তরুণ-তরুণীরাই আপনার কবিতার পাঠক ও অনুরাগী। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারের বর্তমান সময়ে হালফিল তরুণদের মধ্যে কবিতার প্রতি টান বা প্রীতি কি হ্রাসমান, এ ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হেলাল: এখন তো কম্পিউটার, অন্তর্জাল ও ফেসবুকের যুগ। হ্যাঁ, বই পড়া কমেছে আগের তুলনায়। ধরো, ফেসবুকে আমি একটি কবিতা পোস্ট করলাম। মুহূর্তের মধ্যে গোটা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ছে। আবার ফেসবুকের দুর্বলতাও আছে। বড় দুর্বলতা হলো, দ্বিতীয় বা তৃতীয় কেউ সম্পাদনা করার নেই। নান্দনিকতার একটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে সে কারণে। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের সুরুচির দ্বারা শাসিত না হন, তবে সেটা কুৎসিত আকার ধারণ করে।

এ-ও সত্য, কম্পিউটার, ফেসবুক পুরো দুনিয়াকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বড়ই বিস্ময়কর অগ্রগতি। ধরো, নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিতে তুমি জানতে চাইলে অমুক বইয়ের অমুক পৃষ্ঠাটা আমি দেখতে চাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেটা পেয়ে যেতে পারো তুমি। এই যে চমৎকার সুবিধা, এটা এনে দিয়েছে ফেসবুক বা অন্তর্জাল। এই অন্তর্জাল যেমন ওপরে ওঠার সিঁড়ি, তেমনি নিচে নামারও সিঁড়ি। কথা হলো, কে কীভাবে ব্যবহার করছে, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করে।

এখানে আতঙ্কের কথাও রয়েছে। একেবারে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে বা মেয়ে, তাদের জন্য এই সুযোগ মারাত্মক তো বটেই। এসব ডিভাইস তাদের হাতে নিশ্চিন্তে তুলে দেওয়া যেমন খানিকটা বিপজ্জনক, তেমনি ওদের একেবারে বঞ্চিত করে রাখাটাও বোকামি। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল সেট যদি না দাও, তাহলে ওরা পিছিয়ে পড়বে। অনেকে তো মোবাইলে পড়াশোনাও করে থাকে আজকাল। একটা ছেলে বা মেয়ে যখন বাড়ির আলাদা রুমে থাকে, তার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই রয়েছে।
হাসান: এই সংকট মোকাবিলার উপায়টা কী তাহলে?
হেলাল: উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মারধর করা যাবে না। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। ওদের প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত করা মানে হলো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া। দেখো, মুঠোফোন দারুণ উপকারীও। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজখবরও তরুণ-তরুণীরা এর মাধ্যমে নিতে পারছে। আবার এই মোবাইল দিয়ে সাবালক মানুষও আজেবাজে কাজ করছে। তাদের সংখ্যাই হয়তো বেশি। তারপরও এ বিষয়ে শেষ কথা হলো, হালফিল দুনিয়ায় আইটি আমাদের এক ধাক্কায় চার-পাঁচ শ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে সহজ, সুন্দর ও সৎভাবে আইটি ব্যবহার করতে পারলে সেটা দেশের জন্য সেটি মঙ্গলজনক হবে বলেই আমি মনে করি।
হাসান: সম্প্রতি দুই দফা হাসপাতাল থেকে ফিরলেন। বেশ ধকল গেছে। এখন মৃত্যুচিন্তা কি আসে আপনার মধ্যে?
হেলাল: এ বছরের মে মাসে ল্যাবএইড হাসপাতালে যখন প্রথম দফায় গেলাম, এ রকম একটা ধারণা হয়েছিল যে আর বোধ হয় ফিরতে পারব না। খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে মনে পড়েছিল আমার শৈশব, কৈশোর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা, দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক যে জীবন আমি যাপন করে আসছি, সবকিছু মনে পড়ছিল। প্রেসক্লাবে তিন বেলা আমি আহার করি। জীবনের খুব লম্বা একটা সময় এখানে কাটালাম।
তবে এখন মনে হয়, বিদায়ের সময় তো একপ্রকার হয়েই গেছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭১-৭২ বছর। সেটা তো আমার হয়েই গেছে। যদি বিদায় নিতেই হয়, বিধাতা, প্রকৃতি কাউকে দোষারোপ করার কিছু নেই। মৃত্যু নিয়ে আমার বিশেষ কোনো ভয় নেই। তবে কথা হলো, কে অত সহজে যেতে চায়? একরকম অতৃপ্তি থাকেই। মনে হয়, জীবন যদি আরেকটু দীর্ঘায়িত হয়, বেশ হয় তাহলে। আরও একটুখানি সময় যদি থেকে যাওয়া যায়, মন্দ হয় না। তবে হ্যাঁ, আমার কোনো অতৃপ্তি-অনুতাপ নেই। সত্য বটে, সময়ের অপচয় করেছি। সেটা না হলে হয়তো আরও ভালো হতো। যা গেছে, গেছেই। গন ফর এভার।
এখন যে কদিন পরমায়ু আছে, মোটামুটি সুস্থ থাকতে পারলেই ভালো—এটাই সামান্য চাওয়া। শরীর অনেকটাই ঠিক নেই। শরীরের অনেক অর্গান তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। চোখ নিয়ে গুরুতর সমস্যা রয়েছে। ভালো লেখার জন্য অনেক পড়াশোনা করতে হয়। চোখের কারণে সেটা পারি না। আরও একটা উপলব্ধি হয়েছে আমার, ৫০-৫৫ বছর পর্যন্ত একার জীবন, ইটস অলরাইট। তারপর সঙ্গী লাগে। এই যে প্রয়োজনের কথা বলছি, সেটা শুধু শরীরের চাহিদার কারণেই নয়। একজন বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য বন্ধু সব সময় পাশে থাকা খুবই প্রয়োজন। সেই অভাবটা অনুভব করি। আর আমি যেহেতু হোটেলে বসবাস করি, সুতরাং আমার অসুবিধাটা একটু বেশি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় একজন বন্ধুর পাশে থাকাটা জরুরি। বাট, ইটস টু লেট! এখন অবশ্য কিছুই আর করার নেই।
হাসান: ধরুন, আপনাকে বাংলাদেশের সর্বময়, একক, নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব দেওয়া হলো, কোন কাজটাকে অগ্রাধিকার দেবেন তখন?
হেলাল: হা হা হা, এমন ক্ষমতা আমি নেবই না। আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় আলস্য, নারীর চেয়েও প্রিয়। ক্ষমতা যদি নিইও, রাষ্ট্রের বারোটা বাজবে। একই সঙ্গে আমারও। এটা আসলে আমার কাজই নয়। দেখলে না, সারা জীবনে একটা বই লিখেই কাটিয়ে দিলাম।

যখন লিখি, তখন আর কিছু খেয়াল থাকে না

রিজিয়া রহমানের এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে। দেশে তখন উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনাবশত ঘটছিল নানা ঘটনা। সেই সূত্রে এল তাঁর উপন্যাস আলবুর্জের বাজ–এর কথা, যেখানে অনেক আগেই তিনি লিখেছেন ধর্মীয় উন্মাদনার বিষয়ে, ওই উপন্যাসের প্রসঙ্গ টেনেই শুরু হলো আলাপন। পরে ধীরে ধীরে ধর্ম ও সংস্কৃতি ছুঁয়ে সে কথা ছড়িয়ে গেল তাঁর লেখার জগতেও। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বদরুন নাহার
বদরুন নাহার: আলবুর্জের বাজ যখন লেখেন, সেই সময়টার কথা মনে আছে?
রিজিয়া রহমান: লেখার প্রথম দিকে ঘরের কাজগুলো দেখতাম আর লিখতাম। শেষের দিকে বের হইনি ঘর থেকে। বুয়া আছে, রান্না করে। টেবিলে খাবার দিয়ে দিত, আমার ছেলে-বউ—ওরা নিজেরাই খেয়ে নিত। আমাকে ডেকে বিরক্ত করত না। হয়তো বিকেলে উঠলাম, ধুমধাম করে সন্ধ্যায় গোসল করে আবার লিখতে বসতাম। যখন লিখি, তখন আর কিছু খেয়াল থাকে না। এই উপন্যাসে তো আছে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারস্যাপার। ওইখানে সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছিল ইরাকের বাগদাদ শহরের বর্ণনা লিখতে। খুবই কষ্ট হয়েছিল। এ বই, সে বই, হেন-তেন কিছুতেই খুঁজে পাই না। খুব টেনশনে আছি। মনে মনে ভাবি বাগদাদ এ রকম হবে, ও রকম হবে। এরপর একদিন স্বপ্নে দেখি বাগদাদের রাস্তায় হাঁটছি! মানে বাগদাদ এত বেশি মাথায় ঢুকেছে যে আমি বাগদাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। তো পরের দিন উঠে কবি রুবী রহমানকে বললাম, ‘রুবী, আমি খুব বিপদে ছিলাম। বাগদাদ শহরকে কিছুতেই মাথায় আনতে পারছিলাম না। কালকে স্বপ্নে আমি বাগদাদ দেখেছি।’ আচ্ছা, বইটা পড়েছ কি? আলবুর্জের বাজ?
বদরুন: জি, পড়েছি।
রিজিয়া: আলবুর্জ পর্বতমালা যেটা, নর্দান মাজেন্দার। ওই জিনিসটা দেখার ইচ্ছা আমার। যেটাতে ওদের ঘাঁটি ছিল। কেমন এলাকাটা? ওখানে ঘরবাড়ি, গ্রাম আছে কি না? ইরানি টেলিভিশনে খুব ভালো ভালো সিনেমা দেখাত। আমি তা দেখতাম। হঠাৎ একদিন দেখি যে নর্দান ইরান। ইরানের যে পাহাড়ি এলাকা আছে, ওটা দেখাচ্ছে। আমি এটার জন্য পাগল হয়ে ছিলাম। আমার মাথার ভেতর কেবল ছিল ওই আলবুর্জ পবর্তমালা। বাগদাদ আর দামেস্ক। দামেস্ক আমি পেয়েছি ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলোর বইয়ে। কিন্তু আলবুর্জ পর্বত পাচ্ছিলাম না। তো টিভিতে দেখলাম একদম রঙিন ছবি! উঁচু পর্বত যার ঢাল বেয়ে, নিচুতে গ্রিন ভ্যালি। দুম্বা চরছে, ছাগল চরছে, বাড়ি আছে।
বদরুন: আলবুর্জের বাজ–এ ভিন্ন মতবাদের কারণে যে দল গঠন, বিষয়টি কি শুধুই আপনার কল্পনা নাকি ইতিহাস থেকে নিয়েছিলেন?
রিজিয়া: অবশ্যই ইতিহাসের। ভিত্তিটা তো ইতিহাসের। আমার আবার বই পড়ার খুব নেশা। ইচ্ছা ছিল মার্কো পোলোর বাংলা বইটা না পড়ার, ইংরেজি বইটাই পড়তে চাই। ওটা আমার ছেলে কিনে এনেছিল। ওই বইটা পড়তে পড়তে এক জায়গায় দেখলাম মার্কো পোলো লিখেছেন, আলবুর্জ পর্বতমালায় একটা ঘাঁটি ছিল। আশপাশের গ্রাম থেকে ওই কম বয়সী—১২ থেকে ২০–এর মধ্যে যাদের বয়স—স্বাস্থ্যবান ওই ছেলেপেলেকে ধরে আনা হতো। ওদেরকে প্রশিক্ষণ দিত, হাশিশের নেশা ধরাত। এভাবে ওদের তৈরি করত।
বদরুন: সারা বিশ্বে এখন মুসলমানদের অনেকেই উগ্র পন্থার দিকে চলে যাচ্ছে...
রিজিয়া: ওটা ওসামা বিন লাদেনই শুরু করেছিল। এই উগ্রপন্থার আবির্ভাবও তো আরবে। ওসামা বিন লাদেনই এটা সামনে এনেছিল। পরে তা ছড়িয়েছে। আর এখন তো এটা একটা অদ্ভুত ফ্যান্টাসির মধ্যে চলে গেছে।
বদরুন: ধর্মীয় উগ্রবাদের যে সমস্যা, তা তো মুসলমানদের দিয়েই করানো হচ্ছে।
রিজিয়া: সারা পৃথিবীতে এখন যে জাতীয়তাবাদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদ—এসব সেই হিটলারের সময় থেকে চলে আসছে। তারপর আন্তর্জাতিকতাবাদ এটা হলো মানুষের স্লোগান। সেটাও তো বহু বছর হয়ে গেল। এখন আবার সবাই পেছনের দিকে ফিরছে। হ্যাঁ, পৃথিবীটা আবার জাতীয়তাবাদের দিকে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। আসলে আমরা ভাষাভিত্তিক জাতি। সেই হিসেবে আমরা নিজেদের বাঙালিরূপে ব্যাখ্যা করি। আসলে ভাষাই আমাদেরকে তৈরি করেছে। যেহেতু আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা, বিভিন্ন বর্ণের লোক মিলেই তো বাংলাদেশ।
বদরুন: আপনার বং থেকে বাংলায় এই বিষয়গুলো আছে। ইসলাম এখানে যে এল, রয়েছে সে প্রসঙ্গও।
রিজিয়া: আমার কথা হলো, নানা দেশে নানান জাতি এসেছে, নানান ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। এখন এগুলো এত বছরে, হাজার বছরে মিশ্র সংস্কৃতি হয়ে গেছে।
বদরুন: আমরা কি সুনির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতিতে পৌঁছাতে পেরেছি বলে মনে করেন?
রিজিয়া: অবশ্যই পৌঁছেছি। ষাট দশক থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত। তবে এই সময়ে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কৃতির যে ধরন–ধারণ, তা কিন্তু এবং আমদানীকৃত একটা সংস্কৃতি।
বদরুন: এখন আমরা পুরোপুরি বাঙালি সংস্কৃতিতে নেই।
রিজিয়া: সেটা হচ্ছে এই যে গ্লোবালাইজেশন বা মুক্তবাণিজ্য। এখানে আমদানি করা সংস্কৃতি, হাইব্রিড কালচার ইচ্ছে করে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সারা পৃথিবী এক ভাষায় কথা বলে। ওয়ালটন র‌্যালি বলে গিয়েছিলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখছি যে একদিন সারা পৃথিবী আমেরিকায় বসে ইংরেজি ভাষায় কথা বলবে।’ তখন আমেরিকা মাত্র ইংরেজদের দলছুট হয়েছে। ওরা প্রথম রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষাকে গ্রাস করল।
এখন কথা হচ্ছে আমাদের মূল পরিচয় নিয়ে। স্পষ্ট করেই বলি, আমাদের আত্মপরিচয় আমরা ধরতে পারছিলাম না। তোমাকে একটা ঘটনা বলি, তাহলে বুঝতে পারবে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত বার্ষিকীতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটা প্রবন্ধ পড়ার জন্য। বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা’। সেখানে আমি সচেতনভাবেই বলেছিলাম, আপনারা দেড় শ বা এক শ বছর ধরে যে রবীন্দ্রচর্চা করছেন, তা পরিপূর্ণভাবে একাডেমিক। তাঁর লেখা, তাঁর লেখার শৈলী, তাঁর কবিতা—এ রকম আরকি। কিন্তু বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা একেবারে অন্য রকম। তা এসেছেও ধীরে। এর কারণ হলো, ব্রিটিশ আমলে আমরা ছিলাম মুসলমান। তারপর হলো কি, সবাই বলা শুরু করল বাঙালি মুসলমান। পরে হলো পাকিস্তান। আমরা হয়ে গেলাম পূর্ব পাকিস্তানি। তখন আমরা লিখতাম, ‘উই আর ইস্ট পাকিস্তানি’। এরও পর ১৯৭১–এর যুদ্ধের পর আমরা বাঙালি হয়েছি। তো এত দেরিতে যখন বাঙালি হয়েছি, রবীন্দ্রচর্চা তো দেরিতেই শুরু হবে। আসলে আমাদের রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে অন্য রকম। কারণ, আমরা অনেক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি।
বদরুন: আপনার বং থেকে বাংলা আলবুজের্র বার্জ—এই দুই উপন্যাসের স্থান ও কাল ভিন্ন হলেও দুটোতেই মুসলমানের ইতিহাস আছে। আবার শওকত আলীর উপন্যাস প্রদোষে প্রাকৃতজন–এ–ও ইতিহাস আছে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
রিজিয়া: না। বাংলাদেশে মুসলমানরা এভাবে আসেনি। এখানে ইসলাম ধর্মটাই এসেছে অন্যভাবে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি কিন্তু এসেছে পশ্চিম বাংলা পর্যন্ত, পূর্ববঙ্গে সে আসেনি। তার আগে কিছু পাঠান এসেছিল, দক্ষিণ ভারত থেকে আর কিছু মোঙ্গল এসেছিল, কিন্তু থাকেনি। শায়েস্তা খান এসে দলবল নিয়ে চলে গেছে। তখন যত সুবাদারই এসেছে, তারা থাকেনি। এই দেশকে তারা পছন্দ করেনি, ভালোও বাসেনি। তারা প্রচুর আয়-ব্যয়, টাকাপয়সা কামাই করে চলে গেছে।
বদরুন: আপনার বং থেকে বাংলা ও শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন—এই দুই উপন্যাসের বিষয়বস্তু ইতিহাস। দুটিতেই কাছাকাছি সময়ের একটা আঁচ আমরা পাই...।
রিজিয়া: না, আমার উপন্যাসের মধ্যে অনেক অধ্যায় আছে। প্রথম যে মানবগোষ্ঠী, সেটাকে আমি নিয়েছি। তারপর আমি একটা পিরিয়ড নিয়েছি, কিন্তু প্রদোষে প্রাকৃতজন–এ শওকত আলী নিয়েছেন চর্যাপদের সময়টা। যে চর্যাপদের সময়টা আমার বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে এসেছে, উনি সেটা নিয়েই তাঁর উপন্যাস লিখেছেন। ওটা শশাঙ্কর সময়। শশাঙ্কর পরে বল্লাল সেন—ওই সময়। উনি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি তো বং থেকে বাংলা লিখেছেন, আমি লিখতে চাচ্ছি চর্যাপদের সময় নিয়ে। চর্যার সময় নিয়ে সেলিনাও (সেলিনা হোসেন) লিখেছে।
বদরুন: নীল ময়ূরের যৌবন।
রিজিয়া: হ্যাঁ। তো, শওকত আলী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি সংলাপগুলো কীভাবে দিয়েছেন? আমি তাঁকে বললাম, ওই ভাষা তো আমি অত ভালো জানি না। আর ওই বাংলায় লিখলে পাঠক একটুও পড়বে না—এসব ভেবে আমি চলতি বাংলা ভাষায় সংলাপ লিখেছি। উনি বললেন, ভাষা নিয়ে আমি খুব সমস্যায় ছিলাম। এরপর আমি বললাম, আপনি লিখুন।
 বদরুন: আঞ্চলিক ভাষায় লেখার প্রসঙ্গে অনেকেই বলেন, এতে পাঠকের পড়তে সমস্যা হয়। কিন্তু চলতি বাংলায় লেখা হয়েও যদি কিছু কিছু সংলাপে সংমিশ্রণ ঘটে, তাহলে কী ঘটে?
রিজিয়া: আমি যেটা করেছি, আবহাওয়াটা আনার জন্য ওটা ব্যবহার করেছি। যেমন ধরো, আলবুর্জের বাজ। এখানে বহু ফারসি, তুর্কি ও আরবি শব্দ আমি ব্যবহার করেছি। যেগুলো জানি আর যেগুলো আমাদের জানা নেই, এমন কিছু তুর্কি শব্দ ফুটনোট দিয়ে তারপর দিয়েছি। তারপর শায়েস্তা খানের সময়কে যেখানে ব্যবহার করেছি, সেখানে অনেক ফারসি শব্দ দিয়েছি। আলবুজের্র বাজ–এতুকি, ফারসি আর আরবি শব্দ বেশি ব্যবহার করেছি।
বদরুন: আপনার কি ভাষাগুলো আগে থেকে রপ্ত ছিল? এই ধরেন, তুর্কি ভাষা?
রিজিয়া: না। তুর্কি ভাষা আমি জানি না। কিন্তু এসব খুঁজলেই অর্থ পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার মধ্যেও অনেক শব্দ মিশে আছে। তাই সমস্যা হয়নি।

Sunday, November 24, 2019

সাফল্য থাকলে আপনার হতাশা কাজ করবে না

পনার দৃষ্টিকোন থেকে এসইও’র ব্যাপারে জানতে চাচ্ছি-?

ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় । এর প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব নিয়েই বলি। তথ্য খোজাঁর জন্য সার্চ ইঞ্জিন অনেক গুরুত্বপূর্নভাবে পৃথিবীর সব দেশেই ব্যবহার হয়। যত দিন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার হবে ততদিনে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের প্রয়োজন হবে। অনেকেই এসইও মানে লিঙ্ক বিল্ডিংকেই বুঝে । এটি খুবই ভূল ধারনা । এসইও তে অনেকগুলো ধাপ আছে। আবার প্রতিটি ধাপ প্রয়োগ করায় দক্ষতা ও কৌশলের প্রয়োজন হয়। নতুন সাইট তৈরিতে যে ধরনের কৌশল হয়, পুরাতন সাইটের এসইও করার ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের কৌশল নিতে হয়।
এফিলিয়েট মার্কেটিং ইত্যাদি আসলে কী?
কোন ওয়েবসাইটে ভিজিটর পাঠিয়ে তাদের প্রোডাক্ট বা সার্ভিস বিক্রি করতে সাহয্য করে তা থেকে নির্দিষ্ট হারে কমিশন উপার্জন করার পদ্ধতি হলো এফিলিয়েট মার্কেটিং। এফিলিয়েট মার্কেটিংয়ের মুল বিষয়টা হলো কেনার জন্য প্রস্তুত এমন ভিজিটরকে মার্চেন্টের সাইটের প্রোডাক্ট পেইজে পাঠানো। প্রথমে আপনাকে ভিজিটর যোগাড় করতে হবে। নানাভাবে আপনি ভিজিটর পেতে পারেন । তারা হতে পারে সার্চ ইঞ্জিন থেকে পাওয়া অর্গানিক ট্রাফিক, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাওয়া রেফারেল ট্রাফিক, আপনার ই-মেইল লিস্টে থাকা সাবস্ক্রাইবার। এছাড়াও অনলাইন মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে আপনি ট্রাফিক জোগাড় করতে পারেন। এফিলিয়েট মার্কেটিং হচ্ছে একটি নিশ নির্বাচন করে, ভিজিটর সংগ্রহ করা এবং এই নিশে ভিজিটরের চাহিদা রয়েছে এমন সব পন্য কিংবা সেবা নির্বাচন করে তা প্রমোট করা।
আপনার হিসেবে এসইও’র ক্রমান্বয়তাগুলো কীভাবে সাজাবেন?
কিওয়ার্ড রিসার্চ, সাইট স্ট্রাকচার তৈরি, কিওয়ার্ড অপটিমাইজড কন্টেন্ট তৈরি, ইন্টারনাল লিঙ্কিং, সোশ্যাল অপটিমাইজেশন, প্রমোশন- লিংক বিল্ডিং/সোস্যাল সিগনাল বিল্ডিং এবং এনালিটিক্স।
ওয়েব ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর সাথে এসইও’র সম্পর্ক কতটুকু বলে মনে করেন?
এসইওর কাজ সাইটে ট্রাফিক নিয়ে আসা। ডিজাইনের কাজ হলো ভিজিটর যাতে সাইটে এসে ৫ স্টার এক্সপেরিয়েন্স পায় সেটা নিশ্চিত করা । প্রোগ্রামারদের সাইটটিকে এমনভাবে তৈরি করতে হয় যাতে সার্চ ইঞ্জিন সহজে সাইটটি ক্রল করতে পারে । তাদের নিশ্চিত করতে হয় এমন কোন টেকনোলজি ব্যবহার না করা যাতে সাইট ইন্ডেক্সিংয়ে সমস্যা হয় অথবা সার্চ ইঞ্জিনের গাইড লাইন ভায়োলেট করে।
এফিলিয়েট মার্কেটিং করতে হলে কি এসইও অবশ্যই জানতে হবে?
এসইও হচ্ছে সার্চ ইঞ্জিন থেকে অর্গানিক ভিজিটর পাওয়ার কৌশল। একটা সাইট অনেকভাবেই ভিজিটর পেতে পারে। সেটা পিপিসি এডভার্টাইজমেন্টের মাধ্যমে, এসইও করে, ই-মেইল মার্কেটিং করে, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে । তাই ভিজিটর যোগাড়ের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে আপনি সার্চ ইঞ্জিনের উপর মোটেও নির্ভরশীল নয়, আপনি শুধু ইমেইল মার্কেটিংয়ের উপর নির্ভরশীল কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল সেই ক্ষেত্রে এসইও না করেও আপনি এফিলিয়েট মার্কেটিং করতে পারবেন।
ধরুন একজন নতুন, যে কিছুই জানে না এফিলিয়েট মার্কেটিং সম্পর্কে। তাকে আপনি কি কি শিখতে বলবেন? কীভাবে শিখতে বলবেন?
অনেক কিছুই শিখতে হবে আবার এই শেখাটা অনেকভাবেই শুরু করা যায়। আমি বলব একটা সাইট কি কি ভাবে উপার্জন করতে পারে সেই বিষয়টা আগে বোঝা দরকার। তারপর কিভাবে দক্ষ ইন্টারনেট মার্কেটাররা একটা সাইট তৈরি করার জন্য নিশ নির্বাচন করে, সাইট তৈরি করে, সাইটের ভিজিটর পাওয়ার জন্য কি কি করে অর্থাৎ এসইও, লিংক বিল্ডিং, ই-মেইল মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, কন্টেন্ট তৈরি, এনালিটিক্স ইত্যাদি বিষয়গুলো জানা উচিত । এছাড়া ওয়ার্ডপ্রেসেটা জানা দরকার।
বাংলাদেশে এই এফিলিয়েট মার্কেটিং কাজের সুযোগ-সম্ভাবনা-বিড়ম্বনা-সমস্যা কেমন?
এফিলিয়েট মার্কেটিং একটা বিজনেস । বিজনেসের জন্য কৌশল, এটিচিউড আর বিনিয়োগ করার প্রয়োজন হয় । এগুলো করতে পারলে সবার সুযোগ আছে। সমস্যা বলতে তিনটি প্রধান–
  1. এই বিষয়ে জ্ঞানের অভাব
  2. ইংরেজিতে ভালো মানের কন্টেণ্ট তৈরি করার ক্ষমতার অভাব।
  3. মানসিকতার সমস্যা– অনেকেই আছে খুব সহজেই আয় করতে চায় । কষ্ট কিংবা বিনিয়োগে উৎসাহী না ।
বর্তমানে বেসরকারীভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন কাজ শেখানোর জন্য। সেগুলো সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন- কতটা মানসম্মত সেইসব প্রতিষ্ঠান? বা আসলেই তারা শেখানোর মতো যোগ্যতা রাখে কিনা?
আসলে এই বিষয় মন্তব্য করা ঠিক হবে না । আমাদের নিজেদের একটা প্রতিষ্ঠান আছে । তাই অন্যেরটা নিয়ে কথা বলা অনৈতিক মনে করি।
সরকারীভাবে কি এরকম কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়? আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে সরকারের জন্য?
অবশ্যয় যায় । আমারতো মনে হয়ে খুব সহজেই তারা চাইলে সেটা করতে পারে। আমি শুনেছি সরকার আউটসোর্সিং নিয়ে অনেক কিছু করেন । অনেক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জেলা পর্যায়েও অনেক কোর্স করিয়েছে। এই সবের আদৌ দরকার ছিলো বলে আমি মনে করি না । সরকারের জন্য পরিকল্পনা নাই । আমি অতো যোগ্য নই । তবে যেহেতু আমি টেকনোলজি নিয়ে কাজ করি আর টেকনোলজি সার্ভিস দেই সেই হিসাবে বলতে পারি সরকার চাইলে খুব সহজে একটা এডুকেশন পোর্টাল বানাতে পারতো । অনলাইনে কোর্সগুলো তৈরি করে দিতে পারতো । মূল অর্থ ব্যয় করা যেতো কোয়ালিটি কোর্স কনটেন্ট তৈরিতে । সাইটের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছানো সহজ হতো । বলতে পারেন সবারতো ইন্টারনেট নাই । কম্পিউটার নাই। তাহলে তাদের ট্রেনিং দিয়ে লাভ কি? এই দুই জিনিষ ছাড়াতো আউটসোর্সিং করা যাবে না । আর সবার ফ্রিল্যান্সিংই করতে হবে কেনো? আরেকটা বিষয় সরকারসহ এই বিষয়ে যারা কথা বলেন টকশো করেন, পত্রিকায় লেখেন তাদের বলতে চাই পুরো মার্কেট সম্পর্কে একটু রিসার্চ করতে পারেন । আমার কাছে আশ্চর্য লাগে যে আউটসোর্সিং ইন্ড্রাস্টি কিংবা ইন্টারনেট মার্কেট বলতে অনেকে ইল্যান্স আর ওডেস্ক-ই বুঝে ।এটা খুবই ভুল হচ্ছে । তাই মার্কেট সম্পর্কে জানা দরকার নাহয় সঠিকভাবে কাজ করা হবে না। তার প্রমান কিছুদিনের মধ্যে পাবেন । আপনি দেখবেন হাজার হাজার হতাশ ফ্রিল্যান্সার । আপনি দেখবেন এদের অনেকই গন্তব্য খুজে বেড়াবে।
আপনার দৃষ্টিকোন থেকে বলুন বাংলাদেশে বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং-এর কী অবস্থান?
আমি পুরো বিষয়টা নিয়ে মোটেও খুশি নই । আমাদের যে ধরনের স্ট্রাটেজি দরকার তা নেয়া হয়নি। জাতি হিসাবে আপনিতো পুরো ওয়েব ইন্ড্রাস্ট্রিকে দেখতে হবে। ভারতে কি আমাদের মতো ফ্রিল্যান্সিংকেই ওয়েব ইন্ড্রাস্ট্রি ভাবে না কি? আমাদের দেশে গার্মেণ্টস যেমন সেই দেশে ওয়েব ইন্ড্রাস্ট্রিও তেমন । তার প্রমান আপনি ওডেস্ক কিংবা ইল্যান্সে যে ধরনের কাজ হয় তা দিয়ে ওয়েবে সার্চ করুন । আপনি দেখেবেন শত শত ইন্ডিয়ান কোম্পানী আছে । এমন অনেক কোম্পানী পাবেন যাতে হাজার হাজার প্রফেশনাল কাজ করে। এরা অনেক ভালো বেতনেই কাজ করে। ব্যক্তিগতভাবে যেটা ৫ ডলারে করা হয়, একই কাজ কোনো কোম্পানী করলে সেটা ২০ ডলার চার্জ করবে। আমাদের উচিত হচ্ছে সেই বিষয়টা ভাবা ।ফ্রিল্যান্সিংয়ে ২০১০-১১ সালে যেমন করেছে বাংলাদেশ একইভাবে সেই রকম করার সুযোগ কমে আসছে। স্কিল্ড ক্যাটাগরির প্রফেশনাল খুব কম আছে এখন । এই সংখ্যা বাড়াতে হবে ।
ফ্রিল্যান্সিং-এ যারা নতুন আসতে চান তাদের নিয়ে আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
আপনি এক্সট্রা কিছু উপার্জনের জন্য, কিছু অভিজ্ঞতার জন্য, নিজেকে যুগোপযোগী রাখার জন্য ফ্রিল্যান্সিংকে প্রথম পছন্দ হিসাবে নিতেই পারেন। এটি আপনার পূরো ক্যারিয়ার হবে কিনা তা ভেবে দেখুন। ক্যারিয়ার নিয়ে আগে পরিকল্পনা তৈরি করুন। সেই পরিকল্পনায় যদি ফ্রিল্যান্সিং থাকে তাহলে সেভাবে এগিয়ে যাবেন । আর না থাকলে কোন কোম্পানীতে কাজ করুন । টাকার আগে ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে হবে। আমার মনে হয় শুরুতে সিনিয়র কারো সাথে কাজ করলে আপনার দক্ষতা পৌনঃপৌনিক ভাবে বাড়বে । দক্ষ হলে উপার্জন জ্যামিতিক হারে বাড়বে। সাধারন ভাবে বলবো- কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ভালোভাবে শিখে তারপর ফ্রিল্যান্সিং শুরু করুন।
প্রশ্নটার সম্মুখীন হয়তো অনেকবার হয়েছেন। আরও একবার- কেমন করে কখন থেকে এই অনলাইন জগতে প্রবেশ?
আমি যখন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করলাম । তখন ই-কমার্স নিয়ে অনেক কথা হতো। ১৯৯৯ সালের কথা । এই বিষয় জানার জন্য যখনি নেট পেতাম সার্চ করতাম । ওয়েবে সার্চ করলে তখন অনলাইনে আয় নিয়ে অনেক এড দেখতাম । সেই থেকেই আগ্রহ । আর আমার ফ্রেন্ডের এক বড় ভাই যার অফিসে আমি এক সপ্তাহ পার্ট টাইম কাজ করেছিলাম, উনি অনলাইনে বেশ ভালো ব্যবসা করতেন । তিনিও একটা অনুপ্রেরনা হিসাবে কাজ করেছে। বিশ্বাসটা জন্মেছে উনার কারনেই। উনার নাম বলবো না কারন উনি প্রচার পছন্দ করেন না । এড়িয়ে চলেন।
আপনি প্রতিদিন কত ঘণ্টা সময় অনলাইনে থাকেন? কীভাবে এই সময়টা ব্যয় করেন?
বিষয়টা একটু অন্যরকম আমার ক্ষেত্রে । আমার অন্য কোনো কিছু করার সুযোগ নাই। দরকারও হয় না। তাই সকালে উঠে শুরু করি ঘুমাবার সময় বন্ধ করি। ঘড়ির কাঁটার মতো চলে ।
প্রথম নিজের কম্পিউটার কবে, কেমন করে পান?
১৯৯৯ সালে । ভাইয়া টাকা পাঠিয়েছিলো । তাই দিয়ে কিনেছি।
নিজের কাজের জন্য কি কি ব্যবহার করেন আপনি?
ল্যাপটপই ব্যবহার করি । তাছাড়া মোবাইল আর ট্যাবে নেট চেক করা হয়।
কাজের মাঝে বিনোদন পান? নাকি বিনোদনের জন্য আলাদা কিছু করেন?
কাজটা নেশা হয়ে গিয়েছিলো অনেক আগেই । অনেক কিছু করতে হয়েছে । অনেক সময় দিতে হয়েছে নিজেকে তৈরি করার জন্য । তাই বিনোদনের কথা ভাবতাম না । একটা সময় এসেছিলো আমার মেয়ের সাথে সময় কাটানোটাই ছিলো আমার বিনোদন । তার সাথে অন্য কিছুই তুলনা হয় না । এমনকি আমি প্রায় ২ বছর ঠিক মতো অফিসে যেতাম না জাহার সাথে থাকার জন্য । এখনো জাহার সাথে সময় কাটানোই বিনোদন ভাবি । আর অবসরে টিভি দেখি।
ফেসবুক আপনার কাজের জন্য কতটা সহায়ক ভূমিকা পালন করে?
আমি যেহেতু ইন্টারনেট বিজনেসের সাথে জড়িত ।এবং আমার কোম্পানী ইণ্টারনেট মার্কেটিং সার্ভিস দেয় আমার ফেইসবুক নিয়ে বেশ কাজ করতে হয় । ফেইসবুক মার্কেটিং স্ট্রাটেজি আমাদের কাজের একটা অংশ। আবার ক্লায়েন্টের অনেকের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য ফেইসবুক সাহায্য করে। আর আমরা লোকাল মার্কেটে কেবল ট্রেনিং দেই। কিছু ওয়ার্কসপ করি। আমাদের প্রচারের ক্ষেত্রে আমরা ফেইসবুককে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করি।
ফেসবুক ছাড়া আর কি কি সোশ্যাল ওয়েবসাইটে আপনি যান? সেগুলোর কাজের পরিধি সম্পর্কে বলবেন?
টুইটার আর লিঙ্কড-ইন । এছাড়া স্লাইডশেয়ার আর ইউটিউব ব্যবহার করি প্রচুর।
আপনার এক্সপোনেন্ট একাডেমি সম্পর্কে বলুন- কীভাবে কেমন করে শুরু? বলুন কাজের ধরণ-পরিধি সম্পর্কেও-?
আপনি হয়তো জানেন ২০০৬ সাল থেকেই আমরা আউটসোর্সিংয়ের সাথে জড়িত । এর আগে আমরা লোকাল মার্কেটের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করতাম । সফটওয়্যার কোম্পানী হিসাবে আমরা অনেক ভালো এগুচ্ছিলাম। কিন্তু দক্ষ প্রফেশনালের অভাবে আমরা সফটওয়্যার ছেড়ে অন্য অনলাইন সার্ভিস দেয়া শুরু করেছি । এখানেও অনেক ভালো করেছি আমরা । আমাদের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিলো তাতে অনেক দূর যেতে পারতাম । আবারো প্রয়োজনীয় লোকবল পাই নাই। তাই আমরা ট্রেনিং শুরু করি। আমরা আমাদের সময়ের কিছু অংশ ট্রেনিংয়ে ব্যয় করি। এখনো সব পরীক্ষামূলক ও ধীরে ধীরে চলছে । আপাতত ইণ্টারনেট মার্কেটিং, ওয়েব ডিজাইন ও ওয়ার্ডপ্রেস নিয়ে কিছু ট্রেনিং করাচ্ছি।
এক্সপোনেন্ট একাডেমি’র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? এবং বর্তমানেই বা এর অবস্থান কি?
এখনো আমরা ট্রেনিংকে আলাদা করিনি। আলাদা ইউনিট করে প্রফেশানালি চালানোর ইচ্ছা আছে। ইচ্ছা আছে বেশ কিছু কোর্স অনলাইনে চালু করা । আপনি হয়তো জানেন ঢাকাসহ বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে আমাদের বেশ ফ্যান ও ফলোয়ার আছে। তারা আমার কাছ থেকে শিখতে চায় । তাই তাদের জন্য কিছু করতে চাই ।
বিডি হায়ার এবং উই বিল্ড লিংক ডট কম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই-?
এগুলো আমাদের মূল বিজনেস সাইট । বিস্তারিত বলা কঠিন । BDHire.com মুলত একটি ভিএ কোম্পানী। আর WeBuildLink.com একটি এসইও কোম্পানী। সাইটগুলো ভিজিট করলে অনেক কিছুই জানতে পারবেন।
বর্তমানে আপনি কি কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত?
ওয়েবে প্রতি ছয় মাস পর পর নতুন সার্ভিস চালু করতে হয় । এই মূহুর্তে আমি দুইটি সাইটের জন্যই নতুন সার্ভিস ডিজাইন করছি। পাশাপাশি বাংলাদেশ মার্কেটের জন্য xponentweb.com থেকে একই ধরনের কিছু সার্ভিস চালু করার জন্য কাজ করছি। এছাড়া বাংলাদেশ মার্কেটের জন্য আরো দুই একটি সাইট চালু করার কথা ভাবছি। তাছাড়া নিজের স্কিল বাড়ানোর জন্য আমি সবসময় পড়াশুনা করি।
কাজ করতে করতে কখনো মনে হয়েছে- ধ্যাত্তেরি! এতো কষ্ট করে কী হবে? দেই সবকিছু ছেড়েছুড়ে?
আমার তেমন মনে হয় না । আমার সাফল্য অনেক । আর আমি খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে সাফল্য আসেই । সাফল্য থাকলে আপনার হতাশা কাজ করবে না ।
ক্লায়েন্টরা যখন খারাপ ব্যবহার করে তখন কীভাবে ম্যানেজ করেন? আপনি ক্লায়েন্টের সাথে কখনো রাফ বিহ্যাভ করেন?
আমার ক্ষেত্রে সেটা হয় না বললেই চলে। আমি যে ক্লায়েন্টের জন্যই কাজ করি তা খুব সিরিয়াসলি কাজ করি। অনেকগুলো অপশনের মধ্যে সবচাইতে শ্রেষ্ঠটি আমি বাছাই করে কাজ করি। তাছাড়া আমি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারি । আমি পড়েছিলাম ক্লায়েন্টকে হ্যাপি না ডিলাইটেড করতে হবে । তাই করার চেষ্টা করি। দেশে বিদেশে সব জায়গায় ক্লায়েন্ট আমাকে অন্যরকম মূল্য দেয়, আমার পরামর্শে সাদরে গ্রহণ করে। যার কারনে হয়তো আমি ঘড়ির কাটার মতো কাজ করতে পারছি।
ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেলিং-এর ব্যাপারে নতুনদের জন্য কোনো পরামর্শ-?
এই বিষয়টা শুরু হয় একটা যখন কেউ সার্ভিস নিতে কোয়েরি করে। আর শেষ হয় প্রজেক্টটা বুঝিয়ে দিয়ে। প্রত্যেক ক্লায়েন্ট আলাদা । প্রত্যেকটি প্রজেক্ট আলাদা । প্রতিটি পর্যায় আলাদা। প্রত্যেকটি সিটুয়েশ্যনে স্ট্রাটেজি আলাদা আলাদা হবে। তাই এই পরিসরে সব বলা যাবে না হয়তো। তবে ক্লায়েণ্টের কাছে সব সময় ট্রান্সপারেন্ট থাকা উচিত। তাদের সব সময় সৎ পরামর্শ দেওয়া, প্রতিটি ধাপে আপডেট করা খুবই গুরুত্বপূর্ন।
আপনি কি নিজেকে একজন সফল ব্যক্তি মনে করেন? কেন?
হা আর না । আমি মুসলিম । তাই আল্লাহ আমাকে যেভাবেই রাখছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকাটাই আমার ধর্ম । আর আমার তুলনায় অনেকেই সফল নয়। আবার অনেকের সাথে আমার তুলনায় হবে না । আমি যা করতে পেরেছি তাতে অনেক খুশি। আরো কিছু করতে চাই ।
অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার। দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ’র পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। সময় নষ্ট হয়নি । আপনি আমার কথা জানতে চেয়েছেন তার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আবুল কাশেমএক্সপোনেন্ট ইনফোসিস্টেম প্রাঃ লিমিটেড-এর সিইও। একজন সফটওয়্যার প্রোগ্রামার, ব্লগার, ইন্টারনেট মার্কেটার, টেকনোলজি টিচার… নানা পরিচয় থাকলেও তিনি মূলত নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। ক্যারিয়ার শুরু টেকনোলজি শিক্ষকতা দিয়ে- অ্যাপটেক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। একসময় লোকাল মার্কেটের জন্য প্রচুর সফটওয়্যার তৈরি করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি থিতু হয়েছেন এই অনলাইন জগতে এসেই। নিজের আউটসোর্সিং বিজনেস পরিচালনার সাথে সাথে ওয়েব টেকনোলজি ও সলিয়্যুশেন নির্বাচনে ব্যবসার ধরন অনুযায়ী ওয়েব স্ট্রাটেজি ও অনলাইন মার্কেটিং পরিকল্পনা তৈরির পরামর্শক হিসাবে মুলত কাজ করে থাকেন । ইন্টারনেট বিজনেস, নিশ মার্কেটিং ও অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং-এ জানাশোনার পরিধি অনেক অনেক। নিজের যোগ্যতাগুলো লুকিয়ে রাখতেই যেনো বদ্ধ পরিকর। তবে নলেজ শেয়ার আর দক্ষ প্রফেশানাল তৈরির লক্ষ্যে পরিচালনা করছেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এক্সপোনেন্ট একাডেমি। যেখানে শিক্ষার্থীদের শেখাতে উজাড় করে দেন নিজেকে। উনার হাত ধরে অনেকেই আজ অনলাইন বিজনেসে স্বাবলম্বী, সফল ব্যক্তিত্ব। এসব ভেবে যেমন আনন্দ পান তেমনি নতুন কাউকে শেখাতেও সমান ভালো লাগে। এছাড়াও কাজ করছেন বিডি হায়ার ডট কম, উই বিল্ড লিংক ডট কম এর সিইও এবং কী পারসন হিসেবে।
জেগে থাকা প্রতিটা মুহূর্ত কাজের মাঝে মগ্ন থাকলেও কখনও তিনি বোরিং ফিল করেন না। কাজকে ভালোবেসে, শ্রদ্ধা করেই সময় পার করেন। আনন্দ পান একমাত্র মেয়ে জাহা’র সাহচার্য। জন্ম ৩০ জুন। আরও জানতে ভিজিট করতে পারেন উনার ব্যক্তিগত ওয়েব ঠিকানা- Kashem.org.

আনলিমিটেড বলতে কিছু নেই- সবকিছুরই লিমিটেশন আছে

সালেহ আহমেদ এর একটি  সাক্ষাৎকার প্রকাশিক হলো মাইন্ডজার এ...

 

 আপনি ডোমেইন-হোস্টিং-এর বিজনেস করছেন অনেক দিন যাবত। ডোমেইন, হোস্টিং ব্যাপারটা সহজ করে জানতে চাই-

সালেহ আহমেদ: মনে করুন আপনি চিন্তা করলেন ওয়েবসাইট তৈরি করবেন। ওয়েবসাইটের জন্য একটি নামের দরকার পড়বে, আর এই নামটিই হচ্ছে ডোমেইন। এই নামের মাধ্যমে সারাবিশ্বের মানুষ আপনার ওয়েবসাইটকে খুজে পাবে। এই নাম হবে ইউনিক, যা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
হোস্টিং হচ্ছে এক ধরণের সার্ভিস। ধরুন আপনি html, css দিয়ে একটি ওয়েব সাইট তৈরি করলেন। এখন এই ফাইলগুলো অনলাইনে রাখতে হবে, যাতে ভিজিটররা সহজেই ফাইলগুলো একসেস করতে পারে। কিছু কোম্পানি আছে যারা উপরোক্ত কাজগুলো নিজেরাই করে দিবে। অনলাইনে এরাই আপনার ফাইলগুলো যত্নের সাথে রাখবে। যারা এই ফাইলগুলো রাখবে তাদের বলে হোস্ট। আর তারা যে সার্ভিসটা দিচ্ছে সেটাই হচ্ছে হোস্টিং সার্ভিস।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: একটি ভালো এবং মানসম্মত হোস্টিং-এর কি কি গুন থাকবে? সালেহ আহমেদ: ভালো ও মানসম্মত হোস্টিং এর নিচের গুণাবলী থাকবে বলে আমি মনে করি।
  • ৯৯.৯% আপটাইম।
  • মানিব্যাক গ্যারান্টি।
  • ২৪/৭/৩৬৫ সাপোর্ট।
  • ওয়েব সাইট চালাতে যেসব প্রয়োজনীয় ফিচারের প্রয়োজন সব থাকবে।
  • ব্যাকআপ সুবিধা।
  • দ্রুত সার্ভার স্পীড।
  • সার্ভার গ্রেড প্রসেসর।
  • কাস্টমারদের পজিটিভ রিভিউ
এ সম্পর্কিত আমার একটি লেখা রয়েছে যা থেকে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: ডোমেইন কেনার সময় কোন কোন সুবিধা-অসুবিধার দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত? সালেহ আহমেদ: মানুষ ডোমেইন মানেই ডট কমকে (.com) মনে করে থাকে। তাই-
  • সব সময় ডট কমকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
  • সহজে মনে থাকে এমন হতে হবে।
  • যেন সহজে বানান করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • যেন শ্রুতিমধুর হয়। উদ্ভট কোনো ডোমেইন পছন্দ করে পাঠককে ভড়কে দেবার প্রয়োজন নেই।
  • ডোমেইন যথাসাধ্য ছোট রাখার চেষ্টা করতে হবে।
  • যেন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠত ওয়েবসাইটের নামের সাথে মিলে না যায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • যেহেতু বাংলাদেশে পেপাল ও ক্রেডিট কার্ড-এর সুবিধা নাই, সেহেতু বাংলাদেশি ডোমেইন রেজিস্ট্রার থেকেই কিনতে হবে। ডোমেইন কেনার আগে কয়েকটা রেজিস্ট্রারের তালিকা তৈরি করুন। তারপর তাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
  • সবাইকে জিজ্ঞাসা করুন ডোমেইনের ফুল কন্ট্রোল প্রদান করে কি না। ফুল কন্ট্রোল ছাড়া ডোমেইন কিনবেন না।
  • ডোমেইনের দামের ব্যাপারে চিন্তা করুন। অনেকেই ২০০-৪০০ টাকায় ডোমেইন অফার করে থাকে। এদের পরিহার করুন। কারন ICANN ডোমেইন নেম নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের ফি ১৮ সেন্ট আর .com এবং .net verisign-এর মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। তাদের প্রাইস ৫০০ টাকার উপরে। তাই বাংলাদেশি রিসেলাররা কিভাবে এই টাকায় দিবে চিন্তা করুন।
  • কম দামে ডোমেইন কিনে পরে প্রতারিত হওয়ার সম্ভবনা বেশি। যেমন- রিনিউ করার সময় আপনার কাছ থেকে বেশি টাকা দাবী করা হতে পারে। অথবা সাইট জনপ্রিয় হলে ডোমেইনটি হাইজেক করা হতে পারে।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ডোমেইন-হোস্টিং বিজনেস-এর ভবিষ্যৎ কেমন বলে আপনি মনে করেন? সালেহ আহমেদ: দিন দিন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে এবং মানুষের মধ্যে ওয়েব তৈরি করার আগ্রহও বাড়ছে। তাই মার্কেটও আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে কিন্তু শুধু মাত্র ডোমেইন এবং হোস্টিং বিক্রি করে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়নি। পাশাপাশি ওয়েব ডিজাইন ও ডেভলাপমেন্ট রাখতে হবে। যদি আপনি ভাল মার্কেটিং করতে পারেন এবং ভাল সেবা প্রদান করতে পারেন তাহলেই আপনি মার্কেটে টিকে থাকতে পারবেন। আর ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট গেটওয়ের অবস্থা সুবিধাজনক হলে বিদেশি মার্কেট টার্গেট করে ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়া যাবে। এবং ভবিষ্যতে একটা সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: ডোমেইন-হোস্টিং-এর ক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার-এর কোনো নীতিমালা রয়েছে কি? সালেহ আহমেদ: যতদূর জানি ডোমেইন-হোস্টিং ব্যবসার জন্য সরকারের কোন নীতিমালা নাই। এ বিষয়ে নীতিমালা করার প্রয়োজন মনে করি। কারণ দেখা যাচ্ছে যার যখন ইচ্ছা মার্কেটে ঢুকে যাচ্ছে। কমদামী একটা রিসেলার হোস্টিং নিয়েই হোস্টিং ব্যবসা শুরু করে দিচ্ছেন। ক্রেতাকে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়া হয় না, এবং অনেকেই এ ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের সাথে প্রতারণা করছেন। নবম শ্রেণীতে পড়া লেখা করা ছেলেও হোস্টিং ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতার অধিকার দেখার মতো তাদের মানসিকতা থাকে না। তারা যা অফার করছেন তা ক্রেতাদের দিতে পারেন না এবং ক্রেতা তাদের কিছু বলতেও পারেন না এবং কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারেন না। ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে জবাবদিহিতার ব্যবস্থার জন্য একটি নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: বাংলাদেশ সরকার বাংলা টপ লেভেল ডোমেইনের জন্য আইসিএএনএন-এর কাছে আাবদেন করেছে অনেক আগে। এ সম্পর্কে জানতে চাই। সালেহ আহমেদ: বিটিসিএল আবেদন করেছে শুনেছিলাম এবং গত মার্চ মাসে চালু হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দু:খের বিষয় হচ্ছে এখন নভেম্বর মাস চলছে। ICANN এখনো এটার সিদ্ধান্ত Pending করে রেখেছে। বাংলা ডোমেইনের ফেসবুক পেজে সেপ্টেম্বরে একটা আপডেটে লেখা দেখলাম আরো ২ মাস লাগবে কিন্তু সেই দুই মাসও পেরিয়ে গেল।
আর যারা বাংলায় ডোমেইন নিবন্ধন করবেন তাদের ইংরেজি ডোমেইনও নিবন্ধন করে নিতে হবে। কারণ যারা বাংলা লিখতে পারে না তারা তো আপনার ওয়েব সাইট ব্রাউজ করতে পারবে না। সরকার যদি নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ না করে তাহলে .ডট বিডি ডোমেইনের মত এই ডোমেইন নিবন্ধন করতে আগ্রহ দেখাবে বলে মনে হয় না।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: একটি ওয়েবসাইটে ভিজিটর কম-বেশী হওয়ার জন্য হোস্টিং কোনো প্রভাব ফেলে কি? কেমন? সালেহ আহমেদ: হুম হোস্টিং অবশ্যই প্রভাব ফেলে। যেমন আপনি ওভারলোড সার্ভারে সাইট হোস্ট করলেন আর সাইট লোড হতে প্রচুর সময় নিল। তখন ভিজিটর আপনার সাইটে দ্বিতীয়বার আসবে না। আবার সার্ভার যদি ডাউন থাকে বেশি তাহলেও আপনি ভিজিটর হারাবেন।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: ইকমার্স বিজনেসে বাংলাদেশের এখন কী অবস্থান? সালেহ আহমেদ: ইকমার্স ব্যবসার অবস্থা এখনো সুবিধাজনক না। মূল কারণ ক্রেতার অভাব। ইকমার্সের ক্রেতা শুধুমাত্র প্রবাসীরা। দেশের মানুষ এখনো ইকমার্স সাইট থেকে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনি বলেছেন- ইকমার্সের ক্ষেত্রে ক্রেতার অভাব। আসলেই কি ক্রেতার অভাব নাকি কেনার মাধ্যম এভেইলেভল না? সালেহ আহমেদ: দেশের মানুষ এখনো অনলাইন থেকে কেনাকাটায় অভ্যস্ত না, এখন ব্যাংক একাউন্ট দিয়ে পেমেন্ট করা যায় সো কেনার মাধ্যম নাই বলা যাবে না। ব্রাক এবং ডাচবাংলার কার্ড দিয়ে পে করার সুবিধা রয়েছে।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: ডোমেইন-হোস্টিং-এর বিজনেসম্যান হিসেবে আপনি সফল, আমরা জানি। এই সফলতার পেছনের কথাটুকু জানতে চাই। সালেহ আহমেদ: যে কোনো কিছু একাগ্রতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে করলে সফলতা আসবেই। আমার যে টার্গেট ছিল তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি তাই পুরোপুরি সফলতা এখনো আসেনি। তবে সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সফলতা একাগ্রতা, সততা ও নিষ্ঠা এগুলোই আমার সফলতার পেছনে কাজ করছে। বেশ কিছু শ্রদ্ধাভাজন মানুষ আমার সফলতার পেছনে কাজ করেছেন। তাদের সাহায্য ও সহযোগিতার কারণেই আমার এতদূর আসা।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: ডোমেইন-হোস্টিং নিয়ে বিশেষ কিছু কি বলার আছে, যা সাধারণ ক্রেতাদের জানা উচিত? সালেহ আহমেদ: সার্ভারে বেশি কোর হলেই সার্ভিস ভাল হয় না। ম্যানেজমেন্ট যদি ভাল হয় তাহলে কম কোরের সার্ভারেও ভাল পারফরমেনস পাওয়া যাবে। আবার বেশি কোরের সার্ভারের পারফরমেন্সও খারাপ পেতে পারে ম্যানেজমেন্ট ভাল না হলে। আনলিমিটেড বলতে কিছু নেই, সবকিছুরই লিমিটেশন আছে। যেমন- মার্কেটে আনলিমিটেড হার্ডড্রাইভ নেই, র‌্যাম নেই, সিপিউ নেই। শেয়ার্ড হোস্টিংয়ে আনলিমিটেড ব্যান্ডউইথও নাই। একমাত্র ডেডিকেটেড সার্ভারের সাথে আনলিমিটেড ব্যান্ডউইথ পাওয়া সম্ভব। হোস্টিং কেনা উচিত কোয়ালিটি দেখে। শেষ কথা হলো- আপনি যে পরিমাণ টাকা দিয়ে হোস্টিং কিনেছেন, সে পরিমাণ সার্ভিস পাবেন। তার বেশি পাবেন না। আর নিজের ডাটার নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করতে হবে। সবসময় নিজের ব্যাকআপ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। তাই প্রোভাইডারের উপর ভরসা করে বসে থেকে নিজের ডাটা হারিয়ে যাওয়ার মত রিস্ক নেয়া যাবে না।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: বাংলাদেশের প্রায় সব ডোমেইন-হোস্টিং কোম্পানী আনলিমিটেড হোস্টিং স্পেস, ব্যান্ডউইডথ, ডাটাবেজ অফার করছে। এটা কি ফাঁকিবাজি তাহলে? সালেহ আহমেদ: হুম, এটা একটা মার্কেটিং ট্রিকস। একে ফাঁকিবাজিও বলা যায়; টার্মস অব সার্ভিসেই লেখা থাকে লিমিটেশন- কি কি করতে পারবেন এবং কি করতে পারবেন না। যখনই আপনি বেশি স্পেস এবং ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার করতে যাবেন তখন বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে একাউন্ট সাসপেন্ড করে দেবে।
দ্য অনলাইন ইন্টারভিউ: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্য। সালেহ আহমেদ: আপনাকে এবং যারা কষ্ট করে পড়েছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ।
সালেহ আহমেদ– মৃদুভাষী, আন্তরিক এবং টেকনোলজির প্রতি এতো নিবেদিত প্রাণ মানুষ খুব কম দেখা যায়। এই চমৎকার মানুষটির জন্মতারিখ ১৯ আগস্ট। সো চিপ হোস্ট নামের হোস্টিং কোম্পানী পরিচালনা করছেন সুনামের সাথে। তিনি ওয়েব ডেভেলপার হিসেবেও সুখ্যাতি পেয়েছেন।
এছাড়াও তিনি আইটেক বাংলা ফোরাম এবং টেক স্পেট ব্লগের এডমিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অনেক দিন যাবৎ।
ডোমেইন-হোস্টিং রিলেটেড যেকোনো সমস্যায় সহায়তা আশা করতে পারেন তার কাছে। 

 লেখাটি নেওয়া হয়েছে  সাক্ষাৎকার সাইট থেকে

Sunday, August 12, 2018

কবিতা হলো প্রাঞ্জল মিথ্যা, এই মনোরম মিথ্যা বলতে বলতে আমি এখন ক্লান্ত - মহাদেব সাহা


প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে একসময় তিনি ছিলেন খুব জনপ্রিয়। সেই কবি মহাদেব সাহা এখন কানাডাপ্রবাসী। তবে বিদেশ-বিভুঁই ভালো লাগে না তাঁর, দ্রুতই ফিরতে চান দেশে। ৫ আগস্ট এই কবির ৭৫তম জন্মদিন। বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টেলিফোনের মাধ্যমে নেওয়া এ সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন তাঁর কবিতাভাবনা, প্রেম ও উপলব্ধির কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
আলতাফ শাহনেওয়াজ: ১৯৪৪ সালের ৫ আগস্ট পাবনার ধানগড়া গ্রামে আপনার জন্ম। তারুণ্যে আপনারা যখন কাব্যচর্চা করছেন, এই বাংলায় তখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। কবি হিসেবে আপনার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রেক্ষাপটের কতটা অবদান রয়েছে?মহাদেব সাহা: বিস্তর অবদান রয়েছে। আমার যখন কৈশোরকাল, তখন ভাষা আন্দোলন হয়েছে। ইতিহাসের অনেক ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষার্ধ দেখেছি, দেশভাগ দেখেছি, মানুষের দেশত্যাগও দেখেছি। এসব দেখতে দেখতে আমার বড় হয়ে ওঠা।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় আমি স্কুলের নিচু শ্রেণির ছাত্র হলেও সবকিছু মনে আছে আমার। আদতে আমাদের কবিতা গড়ে উঠেছে মানুষের জাগরণ, গণ-আন্দোলন—এসবের উষ্ণ নিশ্বাসে, জীবন আর মাটির গন্ধে। এটাই আমাদের কবিতার স্বাতন্ত্র্য ও মূল শক্তি। যখন কলেজে পড়ি, ততদিনে বাঙালির নবজাগরণের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ, ১৯৬২ সালের আন্দোলন, ’৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফা ও স্বাধিকারের সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালির যে জাগরণ সূচিত হয়েছিল, আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। শুধু প্রত্যক্ষদর্শী বললে ভুল হবে, আমি এগুলোর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। কবিতায় আমি যে জীবন, সমাজ ও মানুষকে অনুভব করেছি, এগুলো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছে।
১৯৬৯ সাল। বাংলা বিভাগে পড়ার পর আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে থেকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ওই মিছিলে আমি তাঁর পাশেই ছিলাম। আমার গায়েও গুলি লাগতে পারত। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘ফিরিয়ে দাও রাজবংশ’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলাম স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে। তো, এত কথা বলার অর্থ হলো, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছে আমাদের কবিতাও।

আলতাফ: আপনার অনেক কবিতায়ই দেখা যায় বিবৃতির প্রাধান্য। কোনো বিষয়কে খোলামেলাভাবে কেবল বলে যাওয়া। আছে পুনরাবৃত্তিও। মোটা দাগে এগুলো আপনার কবিতার বৈশিষ্ট্য। শুধু আপনার নয়, আপনার প্রজন্মের অনেকের কবিতায় এই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে। আপনার বা আপনাদের প্রজন্মের কবিদের এ রকম কবিতা লেখার কারণ কী?
মহাদেব: আমরা কি একই রকম বৈশিষ্ট্যে কবিতা লিখেছি? নিশ্চয়ই তা নয়। তবে এটা সত্য, যে সময়ে আমরা বেড়ে উঠেছি, পরিপুষ্ট হয়েছি—তার মধ্যে ছিল মিছিল, আন্দোলন আর অবরুদ্ধ মানুষের প্রকাশিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এ কারণে হয়তো আমাদের কবিতার মধ্যে বলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। সে হিসেবে আমাদের কবিতা নিশ্চয়ই কিছুটা বিবৃতিপ্রধান। এটা ইচ্ছাকৃত। কারণ, মানুষের সঙ্গে আমরা সরাসরি যোগাযোগ করতে চেয়েছি। জানি যে, ‘জেনুইন পোয়েট্রি কমিউনিকেটেস বিফোর ইট ইজ আন্ডার ট্রুথ’। তাই মানব-সংযোগকে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি আমরা। সম্ভবত এ কারণেই কলকাতার কবিতা থেকে আলাদা হয়েছে আমাদের কবিতা। কেবল রূপক ও চিত্রকল্পখচিত বিমূর্ত কবিতার দিকে আমরা যেতে চাইনি। তখন আমাদের কাছে কাব্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি আরাধ্য ছিল মানুষ, মানুষের মুখ। দেখো, রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’, ‘দেবতার গ্রাস’, ‘সামান্য ক্ষতি’, ‘সাজাহান’, এমনকি ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ও রোমান্টিক বিবৃতিতে ভরা। তবে আমাদের সময়ে দু-একজন অবশ্য চিত্রধর্মী কবিতার দিকে গিয়েছিল, সেসব কবিতা টেকেনি। মানুষ গ্রহণ করেনি সেগুলো।
আলতাফ: আপনি কীভাবে নিশ্চিত যে চিত্রকল্পময় কবিতা—আপনার ভাষায় যা ‘চিত্রধর্মী’—সেগুলো টেকেনি?
মহাদেব: একদম নিশ্চিত। আমাদের কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। শত শত বই বিক্রি হয়েছে। কবিতার বই প্রথম সংস্করণে ১ হাজার ২০০ কপি ছাপা হওয়ার চল শুরু হয় আমাদের সময় থেকে। তারপর তিন-চার মাসের মধ্যে ওই বইয়ের প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়। স্বাধীনতার একদম পরপর ১৯৭২-এ বেরোনো আমার প্রথম কবিতার বই এই গৃহ এই সন্ন্যাস-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তিন মাসের মধ্যে সংস্করণ শেষ। আমি, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন কবির, হ‌ুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসান—সবার ভেতরে এই প্রবণতা ছিল। না, কথাটা পুরোপুরি ঠিক হলো না। আবুল হাসানের কবিতা ছিল আলাদা। নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব—কবিতায় এসব সন্ধান করেছে সে। তার কবিতা হলো আত্মমন্ময় কবিতা। আর আমরা সন্ধান করেছিলাম জীবন-মন্ময় কবিতা—জীবন ও মাতৃভূমি। দেশ, দেশের রাজনীতি—এগুলোকে তখন ঠিকঠাকমতো বুঝে উঠতে পারেনি হাসান। বোধ হয় সে কারণেই ওর কবিতায় সমাজ ও দেশকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একসঙ্গে থাকলেও কাব্যাদর্শের দিক দিয়ে সে ছিল আমাদের চেয়ে খানিকটা দূরবর্তী অবস্থানে।
আলতাফ: কিন্তু অনেকে এমন অভিযোগও করেন, কবিতায় এই অবিরল বলে যাওয়া বা বিবৃতিপ্রবণতার কারণে আপনাদের কবিতা কখনোবা তরল হয়ে গেছে।
মহাদেব: আমার তা মনে হয় না। আমার বরং মনে হয়, এতে আমাদের কবিতা সমৃদ্ধই হয়েছে। কেননা, আবার বলছি, আমাদের কবিতা জীবনমুখী। এখানে প্রেম, কাম—এগুলোর পাশাপাশি বিশেষভাবে ছিল রাজনীতি। ফলে কবিতা হেঁটেছে জনমানুষের একই সমতলে। শামসুর রাহমান তো আমাদের এক দশক আগের কবি, তিনি দেশের প্রধান কবি হয়ে উঠলেন কেন? যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষের অবলম্বন ছিল তাঁর কবিতা—সে ‘আসাদের শার্ট’ বা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’—যে নামই বলি না কেন। বিবৃতির যে ধারা, তা শামসুর রাহমান থেকে শুরু। ওই ধারায় আমি এবং আমরাও লিখেছি, যার যার স্বতন্ত্র স্বরে। আমাদের পরেও লেখা হয়েছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহসহ আরও অনেকে লিখেছেন। সেসব কবিতা জনপ্রিয়ও হয়েছে।
আলতাফ: জনপ্রিয় ধারার কবি আপনি। তাই কি এ কথা বলতে চাচ্ছেন, পাঠকের কাছে যাওয়া, বই বিক্রি হওয়া, সাধারণ মানুষের কাছে আদৃত হওয়া—এগুলো কবিতার বড় উদ্দেশ্য?
মহাদেব: অবশ্যই। এগুলো খুবই বড়। আমাদের আগে কবিতা থেকে পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমাদের আগপর্যন্ত অনেক কবিকে নিজস্ব অর্থে বা বন্ধুবান্ধবের টাকায় বই বের করতে হয়েছে। সেদিক থেকে আমরা ছিলাম ব্যতিক্রম। প্রকাশক আগ্রহ করে আমাদের বই বের করেছেন এবং তা বিক্রিও হয়েছে। আর খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, কবিতার চরণগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরা—এসব কিছুকে তোমরা যদি মূল্য না দাও, তাতে কবিতার কিন্তু কোনো ক্ষতি হবে না। হ্যাঁ, তরুণ বয়সে বিদ্রোহ থাকে, আমরাও করেছি; তবুও বলতে চাই, জীবনমুখী বা মানুষের কাছে যাওয়া কবিতা—এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের কবিতার মূলধারা।
আলতাফ: প্রেমের কবি হিসেবে বেশ সুখ্যাতি আছে আপনার। আপনারা তো জীবন দেখে ও জীবন থেকে জীবনমুখী কবিতা লিখেছেন। আপনার প্রেমের কবিতাগুলোও কি জীবন থেকে পাওয়া?
মহাদেব: বাংলা কবিতার দিকে তাকাও, কী দেখতে পাও? প্রেম আছে বাংলা কবিতায় প্রথম থেকেই। প্রেম অনুভবের বস্তু। প্রেমের অনুভূতি ছাড়া কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না। প্রেম তো ভেতরেই থাকে, বাস্তবে এবং স্বপ্ন-কল্পনায় থাকে। প্রত্যেক কবি হয়তো এসব থেকে, বিশেষ কোনো অনুভূতি থেকেই প্রেমের কবিতা লেখেন।
আলতাফ: আপনার জীবনে প্রেম আসেনি? সেই প্রেম আপনাকে কাব্যরচনায় উদ্বুদ্ধ করেনি?
মহাদেব: হয়তো করেছে, আবার করেওনি। কল্পিত প্রেম নিয়ে হয়তো লিখেছি। নিজের জীবনের প্রেমের কথা কী আর বলব! অসংখ্য নারীর ভালোবাসা আমি পেয়েছি। সেই কলেজজীবন থেকে নারীদের ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এর মধ্যে আবার অন্য কিছু খুঁজবে না, আরও সরাসরি বললে দৈহিকতাকে খুঁজবে না, কারণ, কামনাতাড়িত প্রেমের কথা আমি বলছি না। আমার কাছে প্রেম ও মাতৃস্নেহের মধ্যে কোনো পার্থক্য কখনো ছিল না, এখনো নেই। প্রেম তো এক রকমভাবে মাতৃস্নেহই। একটা ঘটনা বললেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ১৯৬১ সালে আমি ঢাকা কলেজে পড়ি, উচ্চমাধ্যমিকে। থাকি হোস্টেলে। তখন হিন্দু ছাত্রদের জন্য আগামসিহ লেনে একটা ছাত্রাবাস ছিল। একে আমরা বলতাম হোস্টেল। ওই হোস্টেলে বসবাসকালে আমি একবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম—টাইফয়েড। সে সময় টাইফয়েড ছিল কঠিন অসুখ। আমাদের হোস্টেলের পাশের বাড়িতে অপূর্ব এক সুন্দরী ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। হোস্টেলের সামনের খোলা জায়গায় আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম, তিনি বারান্দায় বসে সেই খেলা দেখতেন। আমার সঙ্গে তাঁর খুব দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তবে আমাকে দেখে তিনি হাসতেন, মিষ্টি করে হাসা। বিনিময়ে আমিও হাসতাম। ভাব বিনিময় মাত্র এটুকু। আমরা তাঁকে বলতাম উষাদি। তিনি জানতেন আমি কবিতা লিখি।
তো, হোস্টেলে যখন অমি অসুস্থ হলাম, জ্বরের ঘোরে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম, তখন অন্যদের কাছ থেকে শুনে রাতের বেলা উষাদি চলে এলেন আমার রুমে। তখন আমি সংজ্ঞাহীন। সারা রাত তিনি আমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছেন। এরপর সকালবেলা চলে গেছেন। বড় ভাগ্য না থাকলে এটা হয় না! একে তুমি প্রেমও বলতে পারো, মাতৃস্নেহও বলতে পারো। কবিতা লিখে আর কী পাওয়া যায়, বলো?
তারপর উষাদির সঙ্গে আমার আর মাত্র একবারই দেখা হয়েছিল। সেটা ঘটল তখন, যখন টাইফয়েড-আক্রান্ত আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে আমার গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। উষাদি হাত নেড়ে আমাকে বিদায় দিলেন, আমিও হাত নাড়লাম। ও-ই শেষ। কিন্তু ওই প্রেম, ওই স্নেহ আজও আমার মনের ভেতর রয়ে গেছে।
আগেই বলেছি, অনেক নারীর ভালোবাসার আবেশ আমাকে স্পর্শ করেছে। তবে মজার ব্যাপার এই যে তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার দেখা হয়নি, শুধু কথা হয়েছে। প্রেমের এসব কথাবার্তা বাদ দাও। তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, প্রেমের কবিতা লিখলেও আমি কিন্তু প্রেমিক নই। আমার লেখা প্রেমের কবিতা পড়ে অনেকে আমাকে ভালোবেসেছে, কিন্তু আমি কাউকে ভালোবাসিনি। ভালোবাসা শিখিনি। চিঠি নিয়ে আমি অনেক কবিতা লিখেছি। চিঠি পেতেও আমার ভালো লাগে। তবে চমকপ্রদ তথ্য হলো আমি মা ছাড়া কাউকে তেমনভাবে চিঠি লিখিনি। প্রেমের যোগ্য মানুষ আমি নই, তাই বোধ হয় এ জীবনে অফুরন্ত প্রেম পেয়েছি।
আলতাফ: ‘কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়’ আপনার লেখা ‘মানুষের বুকে এত দীর্ঘশ্বাস’ নামে কবিতার একটি পঙ্‌ক্তি। এই পঙ্‌ক্তির মতো আপনার কবিতার অনেক কবিতার পঙ্‌ক্তিতেই আছে দীর্ঘশ্বাস, আছে দুঃখ, বিষণ্নতা, বিষাদ। আপনার কবিতায় এত বিষাদ কেন?
মহাদেব: বিরহকেও আমি প্রেম মনে করি, বিষাদকে আনন্দ মনে করি। বিষাদের মধ্যেই আছে আনন্দ। কেবল কি আমার কবিতাতেই বিষাদ আছে? রবীন্দ্রনাথের কবিতার পাতায় পাতায় ভরা রয়েছে দুঃখ। গীতবিতান-এর প্রতিটি পাতা তো দুঃখ আর অশ্রুতে ভেজা। ‘আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দৌজ দ্যাট টেল অব স্যাডেস্ট’—শেলির উক্তি। তাই বলতে পারি, বিষাদই প্রথম কবিতা। আদি কবি বাল্মীকির প্রথম যে শ্লোক-উচ্চারণ: ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠা তমগম শাশ্বতী সমা’—এর মধ্যে কী আছে? বিষাদ।
আলতাফ: বাংলাদেশের আবাস গুটিয়ে স্ত্রীসহ কানাডায় ছেলের কাছে চলে গেলেন। কেন? এর নেপথ্যে কি কোনো অভিমান আছে?
মহাদেব: না, কারও প্রতি কোনো অভিমান নেই। দেশ ছেড়ে কানাডাতে গিয়েছি বাধ্য হয়ে। দেশে আমার কোনো জীবিকা ছিল না। উপরন্তু আমার ও নীলার (মহাদেব সাহার স্ত্রী) চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের জন্য প্রতি মাসেই বিপুল টাকা ব্যয় হচ্ছিল। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ছেলে তীর্থর কাছে কানাডায়, কানাডার এই শীতলতম অঞ্চল ক্যালগেরিতে চলে এলাম। এখন ফোনে আর কী বলব! নিজের কথা বলতে একদমই ভালো লাগে না। কবিতা লিখে আমি মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত করতে পারিনি। আমার সংগৃহীত বইপত্র সব দিয়ে এসেছি বাংলা একাডেমিকে। যে সময় আমার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়ার কথা, পুরস্কার-সম্মাননায় প্রীত হওয়ার কথা, সে সময় আমি মাঠ ছেড়ে দিয়েছি, রেসে নেই। আমার সম্বল শুধু কিছু কবিতা, গান আর বাংলা বর্ণমালা। এসব নিয়েই সুখে-দুঃখে থাকতে চাই আমি। জন্মভূমি ছেড়ে কারও কি ভালো লাগে? আমারও লাগে না। কিন্তু কী করব! এখন ভাবছি, ঢাকায় একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করতে পারলেই দেশে ফিরব।
আলতাফ: আসছে ৫ আগস্ট আপনার ৭৫তম জন্মদিন। দীর্ঘ জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন, অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ও ঢের। এত দিন পেরিয়ে এসে আপনার উপলব্ধি কী?
মহাদেব: কবিতাও চির-অমর কিছু নয়। পোয়েট্রি ইজ আ পানিশমেন্ট। আমি মনে করি, কবিতা লেখা এক রকম শাস্তি।পৃথিবীর সব বড় কবি—কিটস, বায়রন, র‍্যাঁবো, বোদলেয়ার, ডিলান টমাস, মায়াকোভস্কি, মাইকেল বা রবীন্দ্রনাথ—তাঁদের দিকে তাকাও, দেখবে সবাই একই শাস্তি ভোগ করেছেন। শেষ জীবনে ছেলেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।’ আদতে আমার তেমন কিছু বলার নেই। আমার উপলব্ধি জানতে চাও? কবিতা হলো প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ। প্রকৃতির প্রতিশোধ ভয়ংকর। কবিতা হলো প্রাঞ্জল মিথ্যা। এই মনোরম মিথ্যা বলতে বলতে আমি এখন ক্লান্ত।

সবার পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভব নয় : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়


পশ্চিমবঙ্গে তথা বাংলা সাহিত্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একজন অন্যতম কথাসাহিত্যিক। ২ নভেম্বর ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহ জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁদের আদিনিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। বাবার রেলওয়ের চাকরির সুবাদে শৈশব ও কৈশোরকালে তাঁকে একরকম যাযাবর জীবনযাপন করতে হয়েছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় কলকাতায়। এরপর বিহার, আসাম, কুচবিহার, পূর্ববাংলা, উত্তরবাংলা ঘুরে সবশেষে আবার কলকাতাতেই ফিরে আসেন। মিশনারি স্কুল ও বোর্ডিংয়ে কাটে তাঁর স্কুলজীবন। ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। বিএ করেন কলকাতা কলেজে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষে স্কুলশিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। 
একসময় আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সাংবাদিকতা পেশাকে বেছে নেন। বর্তমানে ‘দেশ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে কর্মরত আছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ প্রকাশিত হয় দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায়। প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ লিখে ১৯৮৫ সালে লাভ করেন বিদ্যাসাগর পুরস্কার। তা ছাড়া আনন্দ পুরস্কার দুবার- ১৯৭৩ ও ১৯৯০ সালে। তাঁর ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮৯ সালে লাভ করেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। যাও পাখি, মানবজমিন, দূরবীণ, পার্থিব, চক্র, পারাপার ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। বাংলাদেশে তাঁর ‘যাও পাখি’, ‘মানবজমিন’ উপন্যাস নিয়ে নির্মিত হয়েছে ধারাবাহিক নাটক। এ ছাড়া বেশ কিছু গল্প অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে টেলিভিশন নাটক। খ্যাতিমান এ লেখকের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অঞ্জন আচার্য।
অঞ্জন আচার্য : বাংলাদেশে আপনার গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন নাটক নির্মিত হয়েছে। সেগুলো দর্শকনন্দিতও হয়েছে বেশ। অনুভূতি কেমন?

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : ভালো, বেশ ভালো। আমার বইয়ের পাঠক বাংলাদেশে আছে। একই সঙ্গে আমার গল্প-উপন্যাস নিয়ে তৈরি করা নাটকও প্রশংসিত হয়েছে বা হচ্ছে। তার মানে আমার পাঠক ও দর্শক— দুই-ই আছে। হা হা হা।

‘যাও পাখি’, ‘মানবজমিন’ উপন্যাসটি নিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ ধারাবাহিক নাটক হয়েছে। নির্মাতাদের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছি কয়েকবার। এ ছাড়া আমার আশ্চর্য প্রদীপ, একটি অমীমাংসিত রহস্যসহ বেশ কিছু গল্প নিয়ে নাটক তৈরি করা হয়েছে।
অঞ্জন : টিভি দেখা হয় আপনার?

শীর্ষেন্দু : খুব দেখা হয়। কাজের প্রয়োজনে দেখতে তো হয়ই, অবসর পেলেও আমি টিভি দেখি। তবে বেশি দেখি কার্টুন ছবি ও টিভি সিরিয়াল। 
অঞ্জন : কার্টুন?

শীর্ষেন্দু : হ্যাঁ কার্টুন। ‘টম অ্যান্ড জেরি’ আমার খুব পছন্দের কার্টুন। আর কার্টুন ছাড়া বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল দেখতে হয় কাজের প্রয়োজনে।
অঞ্জন : লেখালেখির প্রসঙ্গে আসি বরং। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘কবিতা ক্লাস’ বইয়ের শুরুতেই বলেছেন : “কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’— অর্থাৎ যে কেউ কবি হতে পারেন যদি লেখালেখির কলাকৌশলটা তাঁর জানা থাকে। আপনিও কি তাই মনে করেন?

শীর্ষেন্দু : নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কী প্রসঙ্গে এ কথা বলেছেন তা আমি বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয় সবার পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভব নয়। হতে চাইলেই সবাই নিজের ইচ্ছেমতো কিছু হতে পারে না। আর লেখালেখির বিষয়টা একটু আলাদা। সবার লেখার ধাৎ থাকে না। লেখালেখি একটা সাধনালব্ধ শিল্প। এ শিল্পগুণ ভেতরে থাকতে হবে। তারপর নিরলস সাধনা করে যেতে হবে। যেমন ধরো, গান। গান তো আমরা কমবেশি সবাই গাই। স্নানের ঘরে বা বন্ধুদের আড্ডায়। তাই বলে কি আমরা সবাই গায়ক বনে গেলাম? না। কিন্তু এটা বলা যেতে পারে, কেউ যদি গানের লাইনে লেগে থাকে, দীর্ঘদিন গানের ব্যাকরণ চর্চা করে তবে গানের তাল-লয় সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা জন্মাতে পারে। এই বলে সবাই শিল্পী হবে— তা বিশ্বাস করি না। লেখালেখির ক্ষেত্রেও তাই। গাদা গাদা চিঠি লিখলেই কেউ রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাবে না। মগজে কিছু থাকতে হবে।
অঞ্জন : আপনার লেখালেখির শুরুটা জানতে চাই।

শীর্ষেন্দু : বিষয়টি আমার বহু সাক্ষাৎকারেই উল্লেখ করেছি। ছোটবেলা থেকেই পড়ার পোকা ছিলাম। হাতের কাছে যা পেতাম, তাই পড়তাম। খুব ছোটবেলাতেই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশঙ্কর পড়া শেষ করে ফেলি। যাকে বলে অকালপক্ব। ওই লেখা পড়তে পড়তে নিজের ভেতর লেখালেখির একধরনের টান অনুভব করতাম। শুরু সেখান থেকেই।
অঞ্জন : আপনার জীবনে এক সংকটময় মুহূর্ত পার করেছেন। সেই বিষয়টা একটু শেয়ার করবেন?

শীর্ষেন্দু : আমার তো মনে হয় প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কোনো না কোনো সংকটময় সময় পার করতে হয়। তাকে পার করেই জীবন এগিয়ে নিতে হয়। ওই সময়টার কথা আমার অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। নানা টানাপড়েনে চলতে চলতে নিজের জীবনের প্রতি একসময় মায়া চলে যায়। তখন এক বন্ধুর সহায়তায় ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সান্নিধ্য পাই। ঠাকুরের বাণী আমার জীবনে বাঁচার আশা জাগায়। আর বেঁচে আছি বলেই আজ আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। না হলে, লক্ষকোটি নামহীন সাধারণ মানুষের মতোই মরতে হতো।
অঞ্জন : সম্ভবত এ বিষয়টি আপনার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’র নায়ক শ্যাম চরিত্রের মাঝে দেখা যায়।

শীর্ষেন্দু : শ্যামের সাথে আমার জীবনের কিছু কিছু অংশ মিল আছে। তবে শ্যাম চরিত্রকে পুরোপুরি আমার প্রতিবিম্ব ভাবলে ভুল হবে। শ্যামের বিষণ্ণতা ও তা থেকে পরিত্রাণের জন্য নির্বিকার থাকাটা আমার সাথে মিলে যায়। বাকিটুকু কল্পনা ও অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। 
অঞ্জন : লেখালেখিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

শীর্ষেন্দু : এর উত্তর আমি হয়তো কিছু আগে দিয়েছি। এই যে আমি, তোমরা যাকে লেখক হিসেবে চেনো-জানো, আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছো, নানা সময়ে আমাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করো—এই যে সম্মাননা, তা সবই তো এই লেখালেখির জন্য পেলাম। ওটা আমার ধ্যান— আমার পূজা। 
অঞ্জন : কোন সময়টায় সাধারণত লিখতে বসেন?

শীর্ষেন্দু : লেখাটা ভেতরে ভেতরে সব সময় চলতে থাকে, জমাট বাঁধতে থাকে সারা দিন। তবে রাতের বেলাটাকেই লেখার জন্য বেছে নিয়েছি। ওই সময়টায় লিখতে ভালো লাগে।
অঞ্জন : আপনার অধিকাংশ বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা থাকে, পাঠক হিসেবে আপনি সর্বগ্রাসী। তবে ধর্মগ্রন্থ, থ্রিলার, কল্পকাহিনী আপনার প্রিয়।

শীর্ষেন্দু : আমি সব পড়ি। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, সতীনাথ, টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, গোর্কি, কাফকাসহ অনেকের লেখা এখনো পড়ি। ওরাই আমার লেখার জায়গাটি জাগিয়ে তুলেছে—এখনো তুলে যাচ্ছে। তা ছাড়া ভ্রমণকাহিনী আমার খুব ভালো লাগে। ইদানীং ধর্মবিষয়ক গ্রন্থই বেশি পড়া হয়।
অঞ্জন : কোনো এক বিজয়া দশমীর দিনে, আপনারা যাকে বলেন ভাসান, ওই দিন গঙ্গার ওপর ভাসমান লঞ্চ থেকে সরাসরি অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘ইটিভি বাংলা’র এক অনুষ্ঠানে আপনি বলেছিলেন যে, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন। বিজ্ঞানের এই যুগে ভূত-প্রেত বলে সত্যিই কি কিছু আছে বলে আপনি মনে করেন?

শীর্ষেন্দু : হ্যাঁ, ভূত আছে। এটা আমি বিশ্বাস করি। আমার বিশ্বাসের পেছনে যুক্তিসংগত কারণ আছে।
অঞ্জন : কী কারণ?

শীর্ষেন্দু : আমি নিজের চোখে ভূত দেখেছি।
অঞ্জন : ওটা তো দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে, হ্যালুসিনেশন।

শীর্ষেন্দু : না। আমারটা দৃষ্টিভ্রম ছিল না। এ বিষয়টি আমি বহুবার বহু জায়গায় বলেছি। কথাটা কেউ বিশ্বাস করলে করুক, বা না-করুক। ঈশ্বর যেমন মানি, তেমনি ভূতও মানি। 
অঞ্জন : মৃত্যু প্রসঙ্গটি আপনার লেখায় প্রচুর লক্ষ করা যায়। ওটা নিয়ে কিছু বলুন।

শীর্ষেন্দু : সকলেরই মৃত্যু ভয় আছে। কারো কম, কারো বা বেশি। আমি মৃত্যুর প্রেমে পড়িনি। মৃত্যু আমার বন্ধু নয়— শত্রু।
অঞ্জন : নানা প্রশ্নে আকীর্ণ বস্তুগ্রাহ্য এই জগৎ ও জীবন। আপনি আপনার লেখায় সব সময় জীবনের গভীরে নিহিত হিরন্ময় তাৎপর্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন অথবা এই নশ্বর জীবনের মানে কী— এমনতর প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছেন। জীবন সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত মত জানতে চাচ্ছি।

শীর্ষেন্দু : শোনো অঞ্জন, মানুষের বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে মুখ্য বিষয়। এই আমি তোমার সামনে বসে আজ কথা বলছি— তা তো জীবনেরই দান। তুমি হয়তো আমার কথাগুলো লিপিবদ্ধ করবে, পত্রিকায় ছাপবে, লোকে তা পড়বে— জানবে। এই সবকিছু নিয়েই তো জীবন। আমি আমার জীবনযাপনে সব সময় সত্য খুঁজে ফিরি।
অঞ্জন : আপনার সাহসী গোয়েন্দা চরিত্র শবর দাশগুপ্ত সত্যজিতের ফেলুদার মতো তীক্ষ্ণ ও বিচক্ষণ। অনেকে মনে করেন শবর দাশগুপ্ত ফেলুদার নবতর সংস্করণ। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

শীর্ষেন্দু : পৃথিবীর সব গোয়েন্দা চরিত্রে কিছু কিছু মিল পাওয়া যায় সত্যি। কিছু কমন গুণাবলি, যেমন- সাহসিকতা, বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি ইত্যাদি মিল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে শবর দাশগুপ্তকে ফেলুদার নব্য সংস্করণ বলাটা পাঠকের পড়াশোনার সীমাবদ্ধতাকেই প্রমাণ করে। ফেলুদা ছিলেন শখের গোয়েন্দা, আই মিন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। শবর দাশগুপ্ত কিন্তু তা নয়। তিনি প্রফেশনাল ডিটেকটিভ- সিআইডির কর্মকর্তা। দুই চরিত্রের মধ্যে কোনো মিলই তো দেখছি না।
অঞ্জন : আপনি তো অনেক শিশুকিশোর, রম্য সাহিত্য রচনা করেছেন। পাতালঘর, কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, দুধসাগরের দ্বীপ, পটাশগড়ের জঙ্গলে, ঝিলের ধারে বাড়ি, সোনার মেডেল, নৃসিংহ রহস্য, বক্সার রতন, গজাননের কৌটা, গোঁসাই বাগানের ভূত, চক্রপুরের চক্করে, গৌরের কবচ, বনি, নবীগঞ্জের দৈত্য— এমন সব রচনার মুড আপনার কীভাবে আসে? 

শীর্ষেন্দু : মাঝে মাঝে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে লিখতে লিখতে বড় ক্লান্ত হয়ে উঠি। তখন সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এমন সিলি বিষয়ে হাত দিই। তবে সেখানে আমার শৈশবের অনেক প্রসঙ্গ চলে আসে। শৈশব থেকে শব্দ চয়ন করে আমি ওই সব লিখি। ভেতরটা তখন ফ্রেশ লাগে। তা ছাড়া লেখার মধ্যে বহুমাত্রিকতা বা বৈচিত্র্য না থাকলে লেখক হিসেবে টিকে থাকা বড় কঠিন। 
অঞ্জন : নতুনদের লেখা পড়া হয় আপনার? কেমন করছে তারা? ওদের সম্পর্কে কিছু বলার যদি থাকে।

শীর্ষেন্দু : যারা লিখছে তাদের মধ্যে অনেকেই ভালো লিখছে। এপার বাংলা, ওপার বাংলা, দুই দেশেই। তবে আরো পরিশ্রম করতে হবে। আরো গভীরে যেতে হবে। আধুনিক লেখার নামে যা কিছু তা লিখলে সময় তাকে ধারণ করবে না। সময় বড় নিষ্ঠুর। সবাইকে সে আশ্রয় দিতে চায় না। যারা গেঁড়ে বসতে পারে- তারাই পাবে সময়ের স্বীকৃতি। আর একটা কথা বলতে চাই। এখনকার অনেকেরই খ্যাতির পেছনে এমনভাবে ছুটে যেন, খ্যাতি কোনো বাউন্ডারি। আগে তো নিজের ভিতটাকে শক্ত করতে হবে- তারপর না এগিয়ে চলা। খ্যাতির পেছন পেছন ছুটলেই যদি তাকে পাওয়া যেত, তাহলে তো কোনো কথাই ছিল না। সবাই সবকিছু ফেলে ওই ছোটাছুটিই করত। সবকিছুর জন্য অধ্যবসায় চাই। লিখতে হলে পড়তে হবে অনেক। স্কুল-কলেজের মতো কোনো ফাঁকিবাজি পড়া নয়। কেবল পড়ার জন্য পড়া নয়; শব্দের অর্থ বুঝে পড়তে হবে। বাক্যের প্রয়োগ নিয়েও ভাবতে হবে। তবে কোনো লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হলে চলবে না। নিজের স্টাইলটা নিজেরই তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজ যে লেখক সাহিত্য ভুবনে টিকে আছে, তা কিন্তু নকল করে নয়। নিজের স্বতন্ত্র প্রতিভাতেই টিকে আছে। পাঠক অনুকরণীয় কিছু গ্রহণ করে না।
অঞ্জন : অনেক ভালো লাগল দাদা আপনার সঙ্গে কথা বলে। ঋদ্ধ হলাম। আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

শীর্ষেন্দু : তোমাকেও ধন্যবাদ। আশীর্বাদ করি, ভালো থেকো।