মনিকা আলী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক, যিনি এ মুহূর্তে ইংরেজি সাহিত্যে অন্যতম বেস্ট সেলার ঔপন্যাসিক। তিনি ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্যও মনোনয়ন পেয়েছিলেন। 'ব্রিকলেন', 'ইন দ্য কিচেন', 'দ্য আনটোল্ড স্টোরি' তিনটি উপন্যাসই বিশ্বজুড়ে বিপুল সাড়া ফেলেছে। মনিকা আলী প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছেন ঢাকা লিট ফেস্টে আমন্ত্রিত হয়ে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি রাশেদ মেহেদী
রাশেদ মেহেদী: আপনার শেকড় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এসে কেমন লাগছে?
মনিকা আলী: অভূতপূর্ব অনুভূতি। ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। সেই তিন বছর বয়সে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা-মা। এরপর আর আসা হয়নি। অনেকবার আসার পরিকল্পনা করেছি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসা হয়নি। এবার আসতে পেরেছি, জীবনে অনেক বড় কিছু পাওয়া মনে হচ্ছে। লিট ফেস্টের আয়োজকদের প্রতিও অনেক কৃতজ্ঞতা।
রাশেদ মেহেদী: বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ আপনাকে কতটা ভাবায়?
মনিকা আলী: এক কথায় বললে প্রবলভাবে ভাবায়। আসলে আমার হৃদয়ের ভাষাটা তো বাংলা। আমার ভেতরটা বাংলাদেশ। আমার ভেতরে একটা বড় কষ্টবোধ আছে বাংলায় কথা বলতে না পারার জন্য। আমার লেখালেখির যে অন্তর্নিহিত প্রেরণা, সেটা বাংলা থেকেই পাই।
রাশেদ মেহেদী: বাংলা সাহিত্য পড়েন? কীভাবে দেখেন বাংলায় সাহিত্যচর্চাকে?
মনিকা আলী: আগেই বলেছি, বাংলা আমার প্রাণ। বাংলা ভাষা, সাহিত্য সবকিছুর সঙ্গেই বিনি সুতোর টান আছে। আর এবার ঢাকায় এসে বাংলাদেশের মানুষের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ দেখে অভিভূত হয়েছি। সাহিত্যের এই উৎসবে এত মানুষ আসছে, সব বয়সের মানুষ আসছে, সাহিত্যের আলোচনা উপভোগ করছে। এটাই প্রমাণ করে, সাহিত্য-সংস্কৃতি ঘিরে বাঙালির রুচিবোধ কতটা উন্নত।
রাশেদ মেহেদী: বাংলার প্রতি টান থেকেই কি 'ব্রিকলেনে'র কেন্দ্রীয় চরিত্রে বাংলাদেশের মেয়ে নাজনীন?
মনিকা আলী: 'ব্রিকলেন' আমার প্রথম উপন্যাস। ঠিকই বলেছেন, এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ময়মনসিংহের তরুণী নাজনীন। আপনি জেনে থাকতে পারেন, আমার বাপ-দাদার বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। এ কারণেই ওই এলাকার একটা চরিত্র বেছে নেওয়া। উপন্যাসে তরুণী নারীর সঙ্গে তার দ্বিগুণ বয়সী এক ব্যক্তির বিয়ে এবং সেই সংসারের টানাপোড়েনের গল্পটা উঠে এসেছে।
রাশেদ মেহেদী: সংসারের টানাপোড়েনের গল্প 'ব্রিকলেন' থেকে 'ইন দ্য কিচেনে' এসে কি কিছুটা সরে গেছে, রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার আছে।
মনিকা আলী: আমার লেখা সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে, এজন্য ভালো লাগছে। আসলে ফিকশনে গল্পের ভেতরে থ্রিলিং বিষয়টা সব সময়ই থাকে। ব্রিকলেনেও নাজনীন-চানুর জীবনে ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতরে এক ধরনের থ্রিলিং আছে। আবার ইন দ্য কিচেনে গ্যাব্রিয়েল-লেনার সম্পর্কের জন্ম, এগিয়ে চলা, পরিণতি সবকিছুই অন্য ধরনের থ্রিল। আসলে ফিকশনে গতিময়তার অদৃশ্য শক্তিই হচ্ছে থ্রিল। আমার তৃতীয় উপন্যাস 'দ্য আনটোল্ড স্টোরি' আরও বেশি থ্রিলিং মনে হবে পাঠকের কাছে। এর কারণটা বুঝতেই পারছেন। প্রিন্সেস ডায়ানার চরিত্রকে কেন্দ্র করে গল্পটা নির্মিত হয়েছে। ডায়ানাকে ঘিরে বিশ্ববাসীর অসীম কৌতূহল রয়েছে।
রাশেদ মেহেদী: আপনি জনপ্রিয় লেখক, বেস্ট সেলার লেখক। এটাকে কীভাবে উপভোগ করেন?
মনিকা আলী: আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কারণ খুব সহজেই ব্রিকলেনের জন্য ভালো প্রকাশক পেয়েছি আমি। প্রথম বই বের করার জন্য ভালো প্রকাশক পাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে জায়গায় আমি ভাগ্যের আশীর্বাদ পেয়েছি। এরপর পাঠকের কাছে গল্পটা জনপ্রিয় হওয়ার বিষয়টিও কিছুটা ভাগ্যের। তবে লেখক কীভাবে গল্প বলছেন এবং সেটা কতটা মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছে, সেটার ওপর পাঠকপ্রিয়তা নির্ভর করে। আমার এই আত্মবিশ্বাস আছে, আমার লেখা পাঠককে স্পর্শ করতে পেরেছে।
আর আপনি যদি বেস্ট সেলারের কথা বলেন, সেটাকে অগ্রাহ্য করি না। কিন্তু আমি একজন লেখক এবং বিপুল পাঠকের পছন্দের লেখক, এটা ভাবতে নিজের ভেতরটা পুলকে ভরে যায়।
রাশেদ মেহেদী: তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে ছাপা বই কতটা আবেদন ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয়?
মনিকা আলী: তথ্যপ্রযুক্তি মানুষকে এক ধরনের উপযোগ দেয়। ছাপা বই আরেক ধরনের উপযোগ দেয়। ছাপার অক্ষরে যেটা পড়তে ভালো লাগে সেটা কম্পিউটারের পর্দায় পড়তে আপনার ভালো লাগবে না। পশ্চিমা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির, স্মার্ট ডিভাইসের এত বিস্ময়কর আধিপত্য সত্ত্বেও সেখানেও ছাপা বইয়ের বিক্রি কিন্তু কমেনি; বরং অনেক দেশে বেড়েছে। এ কারণে আমি আত্মবিশ্বাসী, ছাপা বইয়ের আবেদন কমাতে পারবে না তথ্যপ্রযুক্তি।
রাশেদ মেহেদী: যদি এমন হতো, মনিকা আলী বাংলায় একটা উপন্যাস লিখেছেন এবং সেটা ঢাকায় অমর একুশে বই মেলায় বেস্ট সেলার হয়েছে। অনুভূতিটা কেমন হতো?
মনিকা আলী: সেটা হতো আমার জীবনের অতুলনীয় অনুভূতি। বাংলাদেশে আমার শেকড়। সে স্বপ্নটা বুকের মধ্যে আছেই।
রাশেদ মেহেদী: আপনাকে ধন্যবাদ।
মনিকা আলী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারটি সমকাল থেকে নেওয়া হয়েছে
No comments:
Post a Comment