Thursday, May 14, 2020

নারী - কাজী নজরুল ইসলাম

সাম্যের গান গাই-
   আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
   বিশ্বে যা-কিছু মহান্‌ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
   অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
   বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
   অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
   নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
   তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
   অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,
   ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
   এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
   নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
   তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছে যত ফল,
   অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
   জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী,
   সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
   পুরুষ এনেছে যামিনী-শানি-, সমীরণ, বারিবাহ!
   দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশীতে হ’য়েছে বধূ,
   পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
   শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
   নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
   নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
   ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।

       স্বর্ণ-রৌপ্যভার,
   নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার।
   নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
   যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
   নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
   জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে!
   জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
   মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্‌।
   কোন্‌ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
   কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
   কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
   বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
   কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
   প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।
   রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী,
   রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।

    পুরুষ হৃদয়-হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না’ক অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব,
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা,-
লব-কুশে বনে ত্যজিয়াছে রাম, পালন ক’রেছে সীতা।
নারী সে শিখা’ল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরা’ল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভুতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে ক’রে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ!
    তিনি নর-অবতার-
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর-
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।
    সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও , উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
     যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।

    শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্‌ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোম্‌টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর ক’রে দাও দাসীর চিহ্ন, যেথা যত আভরণ!

        ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হ’তে আছ মরি’
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি’!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরন-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
   সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!

No comments:

Post a Comment