শুরুতেই একটি পুরনো গল্প বলছি। তখন ১৯৪৬ সাল। ভারতবর্ষজুড়ে দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। মারামারি কাটাকাটি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা করে কিছু করতে পারছে না।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গার ঘটনার বিস্তার ঘটেছে বাংলাদেশে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় দাঙ্গার ঘটনা ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতারা সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য নানামুখি তৎপরতা চালাচ্ছেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
পুরনো ঢাকায় কয়েকজন মুসল্লি হিন্দু পরিবারের ওপর হামলা চালিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে স্বামী-স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে দৌড় শুরু করেছে। এক পর্যায়ে তারা এক মুসলমান পরিবারের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির কর্তা দরজা বন্ধ করে দেন। বাড়িতে যারা ঢুকেছে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখেন, তারা হিন্দু পরিবার। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে।
বাড়ির কর্তা ভীতসন্ত্রস্ত পরিবারটিকে হাতের ইশারায় আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু হিন্দু পরিবারটিকে তাড়া করতে করতে আসা মুসল্লিরা বাড়ির সামনে এসে হৈচৈ শুরু করল। চিৎকার করে বলল, ওদেরকে বের করে দাও। ওদেরকে আমরা চিরতরে শেষ করে দেবো।
দরজা খুলে বাড়ির কর্তা সটান দাঁড়িয়ে বললেন, ওরা আমার মেহমান। আমার জীবন থাকতে ওদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না।
মুসল্লিরা কিছুক্ষণ হৈচৈ করে বলল, এসব আপনি কি বলেন? ওরা হিন্দু; ওরা আপনার মেহমান হয় কি করে?
ওরা হিন্দু না মুসলমান সেটা দেখার বিষয় নয়। ওরা মানুষ। আমার কাছে ধর্মের চেয়ে মানবতা বড়।
মুসল্লিরা হৈচৈ করে চলে গেলো। বাড়ির কর্তাও হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
একই রকম আরেকটি ঘটনা তখন কলকাতায় ঘটেছিল। সেখানে অসংখ্য মুসলিম পরিবার হামলার শিকার হয়। হামলার সময় একটি মুসলিম পরিবার জীবন রক্ষার জন্য বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওই পরিবারে ছিল দুই যুবতী কন্যা। চারদিক থেকে যখন হামলা হচ্ছিল তখন তারা বেদিশা হয়ে পড়েছিল। কোথাও লুকাবার জায়গা পাচ্ছিল না। এ রকম এক সংকটময় মুহূর্তে এক হিন্দু ভদ্রলোক পরিবারটিকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেলেন। তিনি তার বাড়িতে আশ্রয় দিলেন।
আশ্রয় দেয়ার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। হিন্দুরা এসে ভদ্রলোকের বাড়ি ঘেরাও করল। মুসলিম পরিবারটিকে ছিনিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু ভদ্রলোক অনড়। তিনি জীবন দিয়ে হলেও মুসলিম পরিবারটিকে রক্ষা করবেন বলে জানিয়ে দিলেন।
হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, একটা মুসলিম পরিবারকে কেন্দ্র তুমি আশ্রয় দিয়েছ? তাদেরকে আমাদের হাতে ছেড়ে দাও। আমরা ওদের প্রাণ বিনাশ করব।
ভদ্রলোক বললেন, আমার কাছে হিন্দু মুসলিম কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই মানুষ। আমার কাছে বড় হচ্ছে মানবতা।
হিন্দুরা হৈচৈ করে বিদায় নিল। এভাবেই রক্ষা পেল একটি পরিবার।
এবার চীন সফর প্রসঙ্গে বলি। বেশ কিছু দিন আগে চীন সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম ৫০ শতাংশ মানুষই ধর্ম মানে না। তারা মানবতায় বিশ্বাসী। তারা মনে করে, মানব ধর্মের চেয়ে পরম ধর্ম আর নেই।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু কত শতাংশ মানুষ মানবিক? ইসলাম শান্তির ধর্ম, সম্প্রীতির ধর্ম, মানবিকতার ধর্ম। আমরা সেটা কতটুকু মানি? আমাদের আরো বেশি মানবিক হতে হবে। অন্যের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে হবে। মনের পশুত্ব দূর করতে হবে। নিষ্ঠুরতা পরিহার করতে হবে। তা না হলে সত্যিকারের মানুষ হওয়া যাবে না।
লেখক :মোস্তফা কামাল , সাহিত্যিক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, কালের কণ্ঠ।
No comments:
Post a Comment